ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র

সামিনা লুৎফা

সামিনা লুৎফা

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:১৭ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:২১

উনিশ শতকের শেষার্ধে জন স্টুয়ার্ট মিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে যা বলেছিলেন, তা এই একুশ শতকেও বাংলাদেশে অনার্জিতই রয়ে যাচ্ছে যেন। মিল বলেছিলেন, একজন ব্যক্তির নিজেকে প্রকাশ করার অধিকার ততদূর পর্যন্ত যতদূর পর্যন্ত তা অন্য ব্যক্তির ক্ষতির কারণ না হয়। আবার মিল এও বলেছিলেন যে, স্বাধীনতার এই মূলনীতি যদি মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে চিন্তা করি তাহলে যে কোনো একটি মতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার অর্থ হতে পারে সত্যকে স্তব্ধ করার শামিল।

মতামতের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে আরেকটি মতামত দিয়ে, জোর খাটিয়ে বা ভাঙচুর করে নয়; এই স্বাধীনতার ওপরেই গণতন্ত্রের চর্চার শক্তি দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ, কোনো দেশের নাগরিকরা তাদের মতামত স্বাধীনভাবে দিতে পারে না, যখন এমন কেউ সরকারে থাকে যে সমালোচনা সহ্য করছে না, সাধারণত কর্তৃত্ববাদী অগণতান্ত্রিক সরকার এগুলো করে থাকে। কাজেই সবার মত-আলোচনা-সমালোচনা না শুনলে গণতন্ত্র ব্যবস্থাপনার অন্যতম স্তম্ভ যে জবাবদিহি তা আর থাকে না। এমন এক সময়ে এ লেখা লিখতে বসেছি যখন দেশের প্রথম সারির দুটি সংবাদপত্রের অফিসের সামনে চলছে সংঘবদ্ধ হিংস্রতা আর অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী আরেক দৈনিকের সম্পাদককে করছে এয়ারপোর্টে হেনস্তা বা গুলি করে মারছে পাওনা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করা শ্রমিককে, দোহাই দিচ্ছে গোয়েন্দা রিপোর্টের কিন্তু ভুলে যাচ্ছে যে সরকারি বয়ান ফ্যাসিবাদে কিংবা অন্তর্বর্তীবাদে একই রকমের শোনাচ্ছে নাগরিকদের কানে। 

একদল শিক্ষার্থী ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাঙচুর-লুটপাট করছে অন্যের কলেজ, আদালত প্রাঙ্গণে কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে সরকারি কৌঁসুলিকে। নাগরিকদের ভাস্কর্য, প্রতিমা, মাজার বা শিল্পস্থাপনা ভাঙচুর হয়েছে, বাউলদের চুল কেটে দেওয়া হয়েছে আবার সমুদ্রতীরে বেড়ানোর অপরাধে নাগরিকদের করা হয়েছে মারধর কিংবা আন্দোলনে ব্যবহার করা শেষে ছুড়ে ফেলা হয়েছে বা অকারণ ধাক্কাধাক্কিতে তাদের ত্যাগকে স্বীকার না করে পুনর্বাসিত করা হয়েছে ফ্যাসিবাদের সময় পুষ্ট হয়ে ওঠা ঘিখোর দালালদের। আহত আন্দোলনকারীদের প্রতি দরদের অভাব প্রকট হয়ে উঠলেও সুযোগ খুঁজতে থাকা ভুঁইফোঁড়দের আড়ালে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের কথা ভুলতে বসেছি। বাউল গানের আসর, কুম্ভমেলা, আলোচনা সভা, নাটক, কনসার্ট ইত্যাদি কিছু মানুষের ধমকে বন্ধ বা ছোট করা হয়েছে। এসব ভালো লক্ষণ না, কারণ এসব বহুস্বরের উদযাপন ছাড়া সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বৈষম্যহীন অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নির্মাণ সম্ভব নয়। 

৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর বর্ণনা অনুসারে তাদের হেফাজতে থাকা আগের আমলের ছয় শতাধিক ব্যক্তি, যারা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিল বলে জানা গিয়েছিল, সেসব মানুষ কোথাও উবে গিয়েছে, যদিও হালকা হয়ে যাওয়া মামলা (কখনও শতাধিক আরও অভিযুক্তসহ) করা হয়েছে কয়েকজনের বিরুদ্ধে, আর অনেকের বিরুদ্ধে চলছে মামলা বাণিজ্য। আসল খুনিদের নিরাপদে পালাতে দিল কে? এই কথা যখন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ছাপতে পারে তখন ধরে নেব এদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। ধীরে হলেও হয়তো সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র আনাও সম্ভব হবে। তা না হলে সম্ভব না গণতন্ত্রের পথে সকলকে পৌঁছানো। 

মানুষকে তাঁর কথাটা বলতে দিতে হবে এটি যেমন সত্যি, আবার কেউ এমন ‘যা-তা’ বলতে পারবেন না, যা অন্যের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে। যেমন কেউ যদি অনলাইনে একজন প্রান্তিকীকৃত জাতিগত বা ধর্মীয় বা লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয় বা ছড়ায় তাহলে সেটি শাস্তিযোগ্য হবে, কারণ ভুল তথ্য বা অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়াও অপরাধ! ভুল তথ্য বা মিস-ইনফরমেশন আর অপতথ্য বা ডিজইনফরমেশন দুই জিনিস হলেও উভয়েই নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে ব্যবহৃত হতে পারে। ভুল তথ্য কেউ কেউ না জেনেও ছড়াতে পারেন। তবে অপতথ্য তৈরি করতে হয়, বিনিয়োগ লাগে। অপতথ্য প্রচার দণ্ডনীয়। আইনের শাসন থাকলে সে শাস্তি বিধানে আগের নিবর্তনমূলক আইন ব্যবহার না করে ভিন্ন আইনি ব্যবস্থায় যেতে হবে। ফলে মতপ্রকাশের অধিকার যদি অন্যের অধিকার হরণ করে, তবে সেটি অপরাধ হয়। পার্থক্যটা অনেক বড় না হলেও একেবারে কমও না। 

ফ্রিডম হাউস ইনডেক্স (২০২৪) বলছে, বাংলাদেশ সাংবাদিকদের জন্য ‘খুব সংকটপূর্ণ’ একটি দেশ, যেখানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আংশিক। এর কারণ হয়তো এই যে, গত সরকারের আমলের নিবর্তনমূলক আইনগুলো, যেমন– আইসিটি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনগুলো প্রণয়ন ও সেগুলোর নিপীড়নমূলক প্রয়োগ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে ছিল, যা ক্ষমতায় থাকা সরকার ছাড়া আর কাউকে নিরাপত্তা দেয়নি। বরং এ আইনগুলো দিয়ে নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল বছরের পর বছর। সামাজিক মাধ্যমে সরকারের যেকোনো সমালোচনা এসব আইনের বলে যে কাউকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারত। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার হওয়া আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে গুম করার চেষ্টায় ব্যর্থ সরকার তাঁকে জেলে রাখে ১০০ দিনের ওপরে আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদের কারা অভ্যন্তরে রহস্যজনক মৃত্যু হয়, কার্টুনিস্ট কিশোরকে সহ্য করতে হয় নানা মাত্রার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। 

এ আইনের কারণে নাগরিকদের সেলফ সেন্সরশিপ মাত্রা ছাড়ায়। আমরা দেখেছি, ফেসবুকে ‘হাসি না’ লেখার ‘অপরাধে’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনামূলক পোস্ট লেখার ‘অপরাধে’ রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজুম মুনিরাসহ আরও অনেক নাগরিক জেল খেটেছেন। তারাসহ আরও অনেকে নানাভাবে বছরের পর বছর ধরে লাঞ্ছনা ও নিপীড়ন সহ্য করেছেন আওয়ামী রেজিমের। এসবের ফল হলো নাগরিকরা মতপ্রকাশে ভয় পেয়েছে, মাইদুলদের দৃষ্টান্ত তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশে নিরুৎসাহিত ও পরে চুপ করিয়ে দিয়েছে। 

সংবাদ মাধ্যমের ওপরেও অনেক নিপীড়ন হয়েছে। আমার দেশ, দিগন্ত টিভিসহ বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বিরোধী মতামতের সংবাদমাধ্যম।  বাকি সংবাদমাধ্যম দশকের বেশি সময় ধরে ধীরে ধীরে সেলফ-সেন্সরশিপের মধ্যে ঢুকে গেছে। এ রকম একটা পরিবেশের মধ্যে মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে সবচাইতে চরম নিপীড়ন নেমে আসে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় যখন সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে নাগরিকের মানবাধিকার সবচাইতে বড় ক্ষতির শিকার হয়। ওই সময় টিভি চ্যানেলগুলো সরকারি প্রচারযন্ত্রে পরিণত হলেও কয়েকটি সংবাদপত্রের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা থামায়নি। এ কারণে নাগরিকের তথ্য পাওয়ার উৎস হিসেবে সেগুলো আবার আস্থায় প্রতিস্থাপিত হয়। 

অথচ সেই সব আস্থাভাজন সংবাদপত্রের মধ্যে দুটি অর্থাৎ প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের অফিসের সামনে যেভাবে কয়েক দিন ধরে সংঘবদ্ধ হিংস্র হামলা চালানো হয়েছে এবং সরকার যেভাবে সে আন্দোলন দমনে শক্তি ব্যবহার করেছে উভয়েই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থি। যে কোনো সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হতেই পারে। কিন্তু তারও একটা সীমা আছে। গরু জবাই, জেয়াফত, নামাজ পড়ে প্রতিবাদ ছাড়াও ধাক্কাধাক্কি করেছে আন্দোলনকারীরা আর সেনাবাহিনী এবং পুলিশ আন্দোলন দমন করেছে। রাজশাহীতে প্রথম আলোর অফিস ভাঙচুর হয়েছে, যা সবই গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। 

শুধু স্বৈরাচারী সরকারই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে না, তার ব্যবস্থাও করে– এ কারণে আমরা স্বৈরাচারমুক্ত দেশেও দেখি ঢালাও অভিযোগে ১৬৭ সাংবাদিকের প্রেস কার্ড বাতিল করা হয়েছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য সুফল বয়ে আনবে না। এ ছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যেভাবে ইনডেমনিটি দিয়ে আইন করা হচ্ছে তাতে এ সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করলে জেলে যাবার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তাহলে আর কেন এত হাজার শিক্ষার্থী-জনতা প্রাণ দিলেন আর কেনই বা আমরা ফ্যাসিবাদ হটানোর লড়াইয়ে শামিল হলাম– যদি পাই নতুন বোতলে পুরোনো জিনিস! গণতন্ত্র ফেরত চাইলেই সেটি ফেরত চলে আসে না। গণতন্ত্র ফেরত আসে কেবল গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে আর কোনোভাবে না। গণতন্ত্র চর্চার মূল মাধ্যম হলো মুক্ত এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, যেখানে নাগরিকরা বস্তুনিষ্ঠ খবর পাবেন, সরকারের সমালোচনা পাবেন এবং নিজেরাও করতে পারবেন আর সে খবর প্রকাশের দায়ে কেউ সংবাদপত্র অফিস আক্রমণ করবে না, ভাঙচুর করবে না। 

শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×