ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বুর্জোয়াদের রাজনীতিতে মানুষের আস্থা নেই

বুর্জোয়াদের রাজনীতিতে মানুষের আস্থা নেই

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:৩৮ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৪:৩৯

গত ৫ আগস্ট ঘটেছেটা কী? সেটার বিবেচনা খুবই জরুরি। কেউ বলছেন, আমরা দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলাম। কারও কারও ধারণা আরও অগ্রসর। তারা বলছেন, দেশে একটা বিপ্লবই ঘটে গেছে। বাস্তবে কিন্তু দুটির কোনোটাই ঘটেনি। যেটা ঘটেছে তা হলো, একটি সরকারের পতন। এ দেশে মানুষ অনেক রকমের সরকার দেখেছে; ব্রিটিশ সরকার আলাদা, সেটা ছিল বিদেশি, পাকিস্তানি শাসকরাও বিদেশিই ছিল; কিন্তু পতিত সরকারটির মতো স্বদেশি সরকার আগে কেউ কখনও দেখেনি।

আমাদের দুর্ভাগ্য কোনো সরকারই জনগণের পক্ষে ছিল না, সকল সরকারই ছিল জনবিরোধী। শাসকেরা নানাভাবে শোষণ করেছে, যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। কিন্তু যে সরকারকে জনগণ এবার বিতাড়িত করল, সেই সরকারের মতো নিষ্ঠুর ও বধির সরকার আর দেখা যায়নি। এই সরকার কোনো আইনকানুন মানেনি। সরকার পরিবর্তনটা শান্তিপূর্ণভাবেই ঘটতে পারত, যদি স্বাভাবিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হতো। কিন্তু সরকার তাতে সম্মত ছিল না। নির্বাচনের নামে একের পর এক প্রহসন ঘটিয়ে টিকে থাকার আয়োজন করেছে। ফলে পতন শেষ পর্যন্ত ঘটলই, তবে সহিংস উপায়ে। তাতে বহু মানুষ হতাহত হলেন, সম্পদ ও স্থাপনা নষ্ট হলো। পুলিশ আগেই জনবিচ্ছিন্ন ছিল, এবার তাদেরকে যে ভূমিকায় নামানো হলো, তাতে তাদের ভাবমূর্তি দাঁড়াল জনশত্রুর। থানা আক্রান্ত হয়েছে, পুলিশ সদস্যরাও হতাহত হয়েছেন, পুলিশ বাহিনীর পক্ষে জনসমক্ষে হাজির হওয়া হয়ে পড়েছিল রীতিমতো বিপজ্জনক।

আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল সাদামাটাভাবেই এবং ন্যায্য একটা দাবি নিয়ে; সেটা হলো সরকারি চাকরিতে কিছু গোষ্ঠীর জন্য বড় একটা ভাগ সংরক্ষিত রাখার বিদ্যমান বন্দোবস্ত পরিবর্তনের। সংরক্ষিত ভাগটা কেবল বড় নয়, ছিল খুব বড়, শতকরা ৫৬। এতে বাদবাকি চাকরিপ্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছিল। সমস্যাটা ছিল মূলত শিক্ষার্থীদের জন্যই; শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে যারা চাকরির সন্ধানে নামবে বিশেষভাবে তাদের জন্য। শতকরা ৫৬টি চাকরি যদি নির্দিষ্ট কয়েকটি গোষ্ঠীই নিয়ে নেয়, তাহলে অন্যদের জন্য পাওয়ার সুযোগ আর কতটা থাকে?

কেবল নামেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান। শুরু করেছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, এসে যোগ দিয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। এসেছে স্কুল, কলেজের ছেলেমেয়েরাও। সবাই বৈষম্যবিরোধী। কিন্তু কেবল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সীমিত থাকলে এই গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হতো না। সম্ভব হবার কারণ এতে যোগ দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষও। উন্নয়নে তারা বঞ্চিত। শুধু বঞ্চিত নন, নির্মমভাবে নিষ্পেষিত। 

পিতা চলে গেলেই পিতৃতান্ত্রিকতা যে বিদায় হয় তা নয়। পিতৃতান্ত্রিকতার অবসান ঘটানোর জন্য একটি সামাজিক বিপ্লব আবশ্যক। আমাদের দেশে সে বিপ্লব আজও ঘটেনি। মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকারের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি; ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণও যে সহসা ঘটবে এমন আশা নেই। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর নিশ্চয়তা প্রাপ্তি দূরের সুখস্বপ্ন বটে। আর সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেহেতু ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা ঘটেনি, তাই বৈষম্য উৎপাদনের প্রকৃত ক্ষেত্রটি অক্ষুণ্নই রয়ে গেছে। আর স্বাধীনতা? সেটা তো আমরা বারবার পাচ্ছি। সাতচল্লিশে পেলাম, পেলাম একাত্তরে, বলা হচ্ছে, এবারও পেয়েছি। কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েছি কি? আবারও স্মরণ করা যাক, প্রকৃত স্বাধীনতার নাম হচ্ছে মুক্তি। মূলত অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই মুক্তি আশেপাশে কোথাও নেই। বৈষম্যের রাজত্বই সর্বত্র ব্যাপ্ত। ওই বৈষম্যের রক্ষক হচ্ছে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদেরই নিকৃষ্টতম রূপ। 

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আওয়াজটা ছিল স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববঙ্গ প্রতিষ্ঠার। মনে হচ্ছিল তার প্রতিষ্ঠা বুঝি ঘটেই যাবে। কারণ অভ্যুত্থানে সমাজতন্ত্রীরাই ছিলেন প্রধান শক্তি। কিন্তু জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তো সম্ভব হয়নি; রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গেছে বুর্জোয়াদের হাতেই। এবং এই বুর্জোয়ারা এতই অধঃপতিত যে তাদের দেশপ্রেম ক্রমাগত নিচের দিকে নেমেছে, তরল পানি যেভাবে নামে। বুর্জোয়ারা ভূমি, নদী, বন, ব্যাংক– যা কিছু দেখতে পেয়েছে, সবকিছু লুণ্ঠন করে কিছুটা ব্যক্তিগত ভোগে, বাকিটা বিদেশে পাচারের কাজে লাগিয়েছে। পুঁজিবাদী ধারায় তারা যে উন্নয়ন ঘটিয়েছে, তাতে মেহনতি মানুষ, যাদের শ্রমে উন্নয়ন ঘটেছে তারা কেবল বঞ্চিতই নয়, উন্নয়নের চাপে বিধ্বস্তও বটে। বাংলাদেশে বর্তমান যে সংকট, সেটি বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার এবং তার শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা সৃষ্ট। রাষ্ট্রের এই শাসকেরা দেশপ্রেমবিবর্জিত এবং আত্মস্বার্থ পুষ্টির সাধনায় লিপ্ত। সম্রাটদের গায়ে জামাকাপড় নেই। ভুক্তভোগী জনগণ সবই দেখে; কিন্তু কিছু বলতে পারে না; কারণ তাদের নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠেনি।  

বৈষম্য বিরোধিতার আওয়াজটা কিন্তু মোটেই নতুন নয়। এটি বঞ্চিতদের অতিপুরাতন রণধ্বনি; কিন্তু তাকে বারবার তুলতে হয়। কারণ বৈষম্য দূর হয় না, হবেও না যদি ব্যবস্থা না বদলায়। ব্যবস্থা না-বদলালে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে, এবং বাড়ছেও। উনসত্তরের ব্যবস্থা-কাঁপানো ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পরে মওলানা ভাসানী তাঁর সেই অসামান্য তরুণ কণ্ঠে আওয়াজটা নতুন করে তুলেছিলেন; বলেছিলেন, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না।’ বিশ্ববরেণ্য এক কবিতার বুঝি প্রথম পঙ্‌ক্তি। ওই উনসত্তরেই ভাসানীপন্থি তরুণ আসাদ যখন পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তখন তাঁর সহযোদ্ধারা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র’। একই আওয়াজ, ভিন্ন শব্দগুচ্ছে। আসাদের পূর্বসূরি বায়ান্নর শহীদ বরকতও ছিলেন একই রাজনৈতিক ধারার মানুষ। সে-ধারাও বৈষম্য বিরোধিতারই, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। এবারের অভ্যুত্থান কেবল ব্যক্তিগত সরকারি চাকরির নিশ্চয়তার দাবিতে কোটাবৈষম্য নিরসনের ছিল না।

বিদ্যমান সমাজ বাস্তবতাটা মোটেই সুখপ্রদ নয়। বিশ্বব্যাপীই এখন মানুষের দারুণ দুর্দশা চলছে। তা থেকে মুক্তির উপায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ও মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বিদায় করে সামাজিক মালিকানার নতুন বিশ্ব গড়ে তোলা। সে জন্য কেবল রাষ্ট্রীয় সংস্কার নয়, সামাজিক বিপ্লবও প্রয়োজন হবে। রাজা ও প্রজার সম্পর্ক ছিন্ন করে, বৈষম্য ঘুচিয়ে ফেলে প্রতিষ্ঠিত করা চাই প্রকৃত সাম্য ও মৈত্রীর সম্পর্ক। তার জন্য সামাজিক বিপ্লব ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই। সংস্কারে কুলাবে না। লুণ্ঠন এবং ত্রাণ তৎপরতা দুটোই সত্য; প্রথমটি ঘটে ব্যক্তিগত মুনাফার লোভে; দ্বিতীয়টি প্রকাশ পায় সমষ্টিগত মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায়। 

প্রথমটির পরিণতি ফ্যাসিবাদে; দ্বিতীয়টি সৃষ্টি চায় সামাজিক বিপ্লবের। ত্রাণকে সামনে আনতে হলে দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা অপ্রয়োজনীয়, কারণ দুর্যোগ এখন সার্বক্ষণিক, দুর্যোগ থেকে মানুষের মনুষ্যত্বকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পীড়ন থেকে পরিত্রাণ। 

রোগ সমাজের গভীরে, এবং রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সংস্কারে কুলাবে বলে আশা করাটা যে বর্তমানে নিতান্তই ভ্রান্তিবিলাস, সেটা যেন না ভুলি। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনকে গুটিয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নেই। সেটা সম্বিতে সার্বক্ষণিকভাবেই থাকা আবশ্যক। মানুষ কাজ চায়, কেবল জীবিকার নয়, মানুষ জীবনের কাজও করতে প্রস্তুত; জীবনের কাজটা সমাজ বদলের। অভাব যার সেটি হলো আন্দোলন। ওই আন্দোলন বুর্জোয়ারা করবেন না, বুর্জোয়ারা বৈষম্যবিরোধী নন, তারা বৈষম্য সৃষ্টি ও লালনপালনের পক্ষে; আন্দোলন করতে হবে বৈষম্যবিরোধীদের, অর্থাৎ সমাজতন্ত্রীদের। সমাজতন্ত্রীরা যদি একটি সুনির্দিষ্ট ও অতীব প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন, তবে দেখা যাবে সেই ফ্রন্টে মানুষ কীভাবে সাড়া দিচ্ছেন, এবং অসম্ভবকে সম্ভব করার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে পাঁচমিশালি একটি যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল, তাতে মুসলিম লীগের পতন ভিন্ন অন্য কিছু অর্জিত হয়নি; এখন আর পাঁচমিশালি না, প্রয়োজন সমাজতন্ত্রীদের যুক্তফ্রন্ট। শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের সাফল্য সামাজিক বৈষম্য দূর করবে না। প্রয়োজন মিলিত হয়ে সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব করে তুলবার পথে এগোনো। এই যুক্তফ্রন্ট জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে; ওই পথে সামাজিক বিপ্লব ঘটবে এই আশা নিয়ে নয়, সমাজবিপ্লবের পক্ষে জাতীয় সংসদের ভেতরে এবং বাইরে জনমত ও জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। নির্বাচনের আগে দাবি হওয়া চাই প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে আসন বণ্টনের; এবং নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক উপাদান যুক্ত করবার অধিকার দানের। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ঘোষণাটাও থাকা চাই যে বায়াত্তরের সংবিধানে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত ছিল, তা কোনোমতেই অমান্য করবে না।  

সমাজ পরিবর্তনকামীদের ঐক্যটা হবে সামাজিক বাস্তবতার পরিবর্তনের লক্ষ্যে। এবং ঐক্য যতটা না নেতাদের হবে তার চেয়ে বেশি হবে কর্মীদের। দেশের মানুষ ওই ঐক্যের জন্য অপেক্ষমাণ। বুর্জোয়াদের রাজনীতিতে তাদের আস্থা শেষ হয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে বর্তমান সরকারের ওপর আস্থা-ভরসাও।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×