তরুণদের কাছেই আমাদের সব প্রত্যাশা

কনকচাঁপা
কনকচাঁপা
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৩৫
স্বৈরশাসনে দেশের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা কখনও ভাঙবে বলে মনে হয়নি। দেশের শাসনতন্ত্রে সহসাই রদবদল হবে এও ছিল অকল্পনীয়। আমরা যারা মধ্যবয়স্ক, তাদের আলোচনায় বারবার শুধু একটা প্রশ্নই উঠে আসত– এই দুঃশাসনের অবসান ঘটবে কবে? মাঝে মাঝে এও মনে হয়েছে, একের পর এক প্রহসনের নির্বাচন আর কারচুপির মধ্য দিয়ে যেভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে, এই অপশক্তির হাত থেকে হয়তো বাংলাদেশকে মুক্ত করা যাবে না। কিন্তু এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে দেশের তরুণ সমাজ। বুঝিয়ে দিয়েছে, তরুণ রক্ত চিরকাল সব অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতন এবং সব শেষে চব্বিশের এই অভ্যুত্থানে তরুণেরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। তাই আজ আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, তার ভিত গড়ে দিয়েছে চব্বিশের বীর যোদ্ধারা। এই তরুণেরা শুধু প্রতিবাদী নয়, একই সঙ্গে মেধাবী; নানা বিষয়ে প্রতিভা যেমন আছে, তেমনি আছে উদ্ভাবনী ক্ষমতা। বিশ্বের নানা প্রান্তে গিয়েও শিক্ষা আর নানা সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে এই তরুণেরাই দেশের নাম উজ্জ্বল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন এই তরুণদের কাছেই আমাদের সব প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ এক পলিমাটির ব-দ্বীপ। সেই মাটির মতোই শ্যামল-কোমল এ দেশের মানুষের মন। সেইসব মানুষের কাছ থেকেই যুগ যুগ ধরে আখের গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে ক্ষমতালোভী সুযোগসন্ধানীরা। কিন্তু দিনের পর দিন বছরের পর বছর এটাই চলে আসবে– এমন মনে করাই ছিল স্বৈরশাসকের বড় ভুল। তরুণেরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের ভুল কোথায় এবং করণীয় কী। এ ক্ষেত্রে তরুণদের প্রধান উপকরণ হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। গত জুলাই মাসে যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করল, তখনই আমরা নতুন করে অনুভবের সুযোগ পেয়েছি আমাদের সংস্কৃতির শক্তি কতখানি। স্লোগান, দেয়ালচিত্র, পথনাটক, প্রতিবাদী গান– এমন অনেক আয়োজন চোখে পড়েছে এই আন্দোলনের সময়ে। যার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে শাসকগোষ্ঠীর নানা অপরাধ-অপকর্মের চিত্র। গান যে যুগে যুগে শোষণ, পীড়ন, অন্যায়-অবিচারে প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, চব্বিশের তরুণেরা তা আরও একবার প্রমাণ করেছে। আমার জানি, সংগীতের এক সম্মোহনী শক্তি আছে, যা আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, আবেগে ভাসিয়ে দেয় আবার শিকড়কে চেনানোর পাশাপাশি তুলে ধরে জীবনের অর্থ। ঠিক একইভাবে গানই খুঁজে দেয় মুক্তির পথ। সংগীত কীভাবে মুক্তিকামী মানুষের হাতিয়ার হয়ে ওঠে– এই প্রশ্নের জবাব পেতে চাইলে একাত্তরের দিনগুলোতেই ফিরে যেতে হবে। সেই সময় সম্মুখ যোদ্ধাদের সাহস-শক্তি জোগানো ও স্বাধীন দেশের মানচিত্র ছিনিয়ে আনতে গানই হয়ে উঠেছিল বড় হাতিয়ার। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর আরও একবার সেই সত্যই নতুন করে উঠে এসেছে আমাদের মাঝে। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে সহিংসতা ঘটেছে, তার প্রতিবাদে যেমন লাখো জনতা রাজপথে নেমেছিল, তেমনি সংগীতযোদ্ধাদের কণ্ঠে তুলে দিয়েছিল বিদ্রোহের সুর। আমরা যাদের নাম শুনিনি, এমন অনেক তরুণ গায়ক-গায়িকা তাদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমাদের অবাক করে দিয়েছে। তাদের কণ্ঠের মানবতার আকুতি, আর্তচিৎকারে উঠে আসা তীব্র প্রতিবাদ, লেখনীতে মিশে থাকা বারুদ, সুরে যে বিদ্রোহের দাবানল ছিল তা একদিকে আমাদের যেমন চমকে দিয়েছিল, তেমনি বুঝিয়ে দিয়েছিল নীরব থাকার সময় শেষ হয়েছে। বন্দিদশা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার এটাই সময়।
দমন-পীড়ন হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যখন শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রুখে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল, ঠিক তখনই বেরিয়ে আসতে দেখেছি আরেকটি দলকে; যারা নিজেদের চিরকাল ভীতু বলেই জেনে এসেছে। বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ, ফাইয়াজ, তাহমিদ, ফারহান, ইয়াসিন, জাহিদুজ্জামান, ফাহাদ, জাফর, জিল্লুরের মতো হাজার হাজার তরুণ শহীদ হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা আর নীরব থাকতে পারেনি। মনে আছে, রাজপথে বেরিয়ে তাদের বলা সেই কথাগুলো– ‘আমাদের প্রজন্ম ৩০ বছর ধরে একটা ভয়ের সংস্কৃতিতে বড় হয়েছে। গানে গানে প্রতিবাদ করা ছাড়া মনে হতো আর কিছুই করার নেই। বয়সে ছোট ছিলাম, ভাবতাম আমাদের কথা কে-ইবা শুনবে। কিন্তু আর কত ভয়? বর্তমান প্রজন্ম আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে আমরা যদি সাহস জোগাই, আমরা সবাই কথা বলতে পারব, ভুলকে ভুল বলার সাহস রাখতে পারব। কারণ আমরা সবাই একটি ন্যায় সমাজ দেখতে চাই ও সত্যের সংস্কৃতি গড়তে চাই। তাই কথা বলা থামানো যাবে না, অন্যায় দেখে প্রতিবাদ করা থামানো যাবে না। আপনারা করছেন, আমরা করছি, আরও অনেক মানুষ করবে। সময় লাগতে পারে, কিন্তু সবাই জেগে উঠছে, এটাই সত্যি।’ এই যে কথা, এই যে তাদের উপলব্ধি, এ সবই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন রচনায় ভূমিকা রেখেছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দিনগুলোয় একদিকে যখন তরুণ শিল্পীরা গানে গানে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তখনও তারকা ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কেউ কেউ সরকারের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে বসে ছিল। আমি তাদেরকে দোষ দেব না, যারা বাঁচার তাগিদে সরকারের হ্যাঁ-এ হ্যাঁ মিলিয়েছে। কারণ যখন অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে থাকে অশক্তির প্রদর্শন, তখন জীবন-জীবিকার তাগিদেই অনেক মানুষকে ক্ষমতাসীনদের কাছে মাথা নত করতে হয়। শুধু সংস্কৃতি অঙ্গন নয়, প্রতিটি অঙ্গনের মানুষই স্বৈরশাসকের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছে। তবে যারা স্বেচ্ছায় এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বৈরশাসকের দোসর হয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে আমি মনে করি। আমাদের শিল্পী সমাজের কথাই যদি বলি, অনেক শিল্পী বছরের পর বছর জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে কাজ করতে পারেননি। এক অদৃশ্য কালো তালিকা তৈরি করে রাখা হয়েছিল সেইসব শিল্পীর জন্য। এমনকি শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে নাচ, গান, অভিনয়– সবকিছুতেই একরকম অবাঞ্ছিত করে রাখা হয়েছিল তাদের। তাই পেশাদার অনেক শিল্পীর জন্য বিগত সরকারের শাসনামল দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আমরা তো কেউ এমন শিল্পী সমাজ চাইনি। শিল্প-সংস্কৃতির সাধনা যারা করেন, তাদের তো সবাইকে এক ছাদের নিচে থাকার কথা, কিন্তু তাদের মাঝে দেয়াল গড়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল স্বৈরশাসকের। কারণ তাদের কাছে আত্মপ্রচারই মুখ্য। আমি মনে করি, শিল্পীদের মতাদর্শ ভিন্ন হতে পারে, সে কারণে তাদের শিল্পচর্চায় বাধা দেওয়ার অধিকার কেউ রাখে না। প্রতিভা দেশের সম্পদ। এতে কোনো বিভাজন তৈরি করা যায় না। কিন্তু এ দেশে বারবার সে চেষ্টাই করা হয়েছে। এ ধরনের মনোভাব নিয়ে কোনো সরকার দেশ পরিচালনা করবে, এটা সত্যি মেনে নেওয়া কঠিন। এ ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে আমাদের সংস্কৃতির মূল্যায়ন কখনোই হবে না। আগামীতে যারা দেশ পরিচালনা করবেন, তারা যেন এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই একেকটি ধাপ অতিক্রম করেন। সেই সঙ্গে তারুণ্যের শক্তিকে জাগ্রত রাখার সব রকম চেষ্টা করে যেতে হবে। সত্যিকার অর্থে হাতে-কলমে যারা কাজ করছে, তাদের সিংহভাগই তরুণ। দেশের উন্নয়নে নানা ধরনের নিরীক্ষা, উদ্ভাবন, উদ্যোগের মাধ্যমে তারাও দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আগামী দিনের সরকারের উদ্দেশে বলব, এসব তরুণের চলার পথ যেন আরও মসৃণ হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিন। তাহলেই তারুণ্যের জয়গানের মধ্য দিয়ে আমরা সুন্দর এক বাংলাদেশ উপহার দিতে পারব।
কণ্ঠশিল্পী
- বিষয় :
- কনকচাঁপা