প্রিয় জামদানি

ফাইল ছবি
আকলিমা আক্তার
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪ | ২৩:২৫
‘তবুও আবার রজনী আসিল,/ জামদানি শাড়িখানি/ পেটেরা খুলিয়া সযতনে দুলী/ অঙ্গে লইল টানি।’– জসীমউদ্দীন
৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন জামদানি শাড়ি পরে হেঁটেছিলেন। তাঁর আকর্ষণীয় শাড়ি ও বডি জুয়েলারি ভক্তদের মুগ্ধ করেছে। এর পর থেকে বাঁধনকে যেন অলিখিতভাবে জামদানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বলা হয়। কেননা, বিভিন্ন সময় প্রিয় কোনো অনুষ্ঠানে তাঁকে জামদানি শাড়িতে দেখা গেছে। অভিনেত্রী ভাবনার কথাই ধরুন। তিনি যখন লন্ডনের ওয়েলসের ইউনিভার্সিটি অব রেক্সাম থেকে সমাবর্তন নিচ্ছিলেন, সেদিন পরেছিলেন ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি। তাঁর পরনে বিস্কুট রঙা হলুদ পাড়ের এ শাড়ি দেখে প্রশংসা করতে ভোলেননি সে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও। এ বছরের মে মাসে ভাবনা যখন ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে যান, সেখানেও তিনি জামদানি শাড়ি পরে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ভাবনাকেও বিভিন্ন সময় নানা রঙের জামদানিতে দেখা যায়। তিনিও যেন জামদানির অলিখিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। গত জুলাই মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুই ফরাসি দূতাবাস আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জামদানির জ্যাকেট পরে হাজির হন। সেখানে তিনি অনেক প্রশংসা পেয়েছেন। ম্যারি মাসদুপুইয়ের পরা জামদানির সে পোশাকটি ডিজাইন করেছেন বাংলাদেশি ডিজাইনার সামি আলম।
জামদানি ইউনেস্কো স্বীকৃত বাংলাদেশি কালচারাল হেরিটেজ। শৈল্পিক বুননের সঙ্গে জামদানিতে মিশে রয়েছে আভিজাত্য। যুগ যুগ ধরে জামদানি এ দেশের সম্পদ। তাই নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন করে বাংলাদেশের অনেক তারকা বিয়েতেও জামদানি পরেছেন। অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিণ বিয়ের দিন লাল জামদানি পরেছিলেন। অভিনেত্রী তিশা বিয়েতে পরেছিলেন সাদা জামদানি। অভিনেত্রী মিথিলা যখন সৃজিত মুখার্জির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন, সেদিন পরেছিলেন মেরুন রঙের জামদানি। খুব সাধারণ মানুষ বলুন আর তারকা কিংবা স্বনামধন্য কারও কথাই বলুন, জামদানির প্রতি সবার আলাদা দরদ এবং ভালোবাসা রয়েছে।
সবার প্রিয় জামদানি কোথা থেকে এলো? জামদানির প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায়, আনুমানিক ৩০০ খ্রিষ্টাব্দে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে। পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি বই এবং বিভিন্ন আরব, চীন ও ইতালির পর্যটক ও ব্যবসায়ীর বর্ণনায়ও জামদানির উল্লেখ রয়েছে। কৌটিল্যের বইয়ে বঙ্গ ও পুণ্ড্র এলাকায় ক্ষৌম, দুকূল, পত্রোর্ণ ও কার্পাসি সূক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ আছে।
৯ শতকে আরব ভূগোলবিদ সোলায়মান তাঁর গ্রন্থ স্রিল সিলাই-উত-তওয়ারিখে সূক্ষ্ম সুতি কাপড়ের উল্লেখ করেছেন। তিনি সে বইয়ে যে রাজ্যের কথা উল্লেখ করেন তার নাম ‘রুমি’। তাঁর বর্ণনা অনুসারে বোঝা যায়, রুমি রাজ্যটি আসলে বর্তমানের বাংলাদেশ। চৌদ্দ শতকে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেন এবং সোনারগাঁয়ের সুতি বস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, প্রাচীন যুগে এ অঞ্চল মিহি ও সূক্ষ্ম কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। বিভিন্ন বিশ্লেষকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রাচীন সেই মিহি বস্ত্রটিই হলো মসলিন। এ মসলিনে করা নকশা থেকেই জামদানি শাড়ির উৎপত্তি।
ঢাকাকেই জামদানির আদি জন্মস্থান বলে ধরা হয়। ঢাকার সোনারগাঁ, তিতাবাড়ি, ধামরাই, বাজিতপুর ইত্যাদি অঞ্চল এ কাপড় উৎপাদনের জন্য শীর্ষে ছিল। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরঘেঁষা অঞ্চল সোনারগাঁয়ের আর্দ্র পরিবেশ এ কাপড় তৈরিতে অবদান রাখত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
নয়ন জুড়ানো নকশা: বংশপরম্পরায় মসলিন ও জামদানি নিয়ে কাজ করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তাঁতি মোহাম্মদ রফিক। তিনি বলেন, ‘জামদানির ইতিহাস ৪০০ বছরের পুরোনো। এই শাড়ির নকশার বর্ণনা কোথাও লেখা নেই। কিন্তু আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শিখেছি এর বুনন কৌশল ও নকশা। পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাচ্ছি।’
জামদানি বুনন কৌশল পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে রপ্ত করলেও, জামদানির কিছু সাধারণ নকশা রয়েছে। আঙ্গুরলতা, ময়ূরপ্যাঁচপাড়, তেরছা, জলপাড়, পান্না হাজার, ঝালর, ময়ূরপাখা, করোলা, দুবলাজাল, সাবুরগা, বলিহার, শাপলা ফুল, বাঘনলি, কলমিলতা, চন্দ্রপাড়, ঝুমকা, বুটিদার ইত্যাদি নকশা করা হয়। এই নামানুসারে জামদানিকে ডাকা হয় বলে জানান তিনি।
এ তাঁতি মনে করেন, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাব; এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের পৃষ্ঠপোষকতা না করায় এ শিল্প অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে।
জামদানির বিচিত্র ব্যবহার: জামদানি কেবল শাড়িতেই আবদ্ধ ছিল না। অনেক আগে থেকে জামদানির ওড়না, শেরওয়ানি ইত্যাদিও তৈরি করা হতো। বর্তমানে এর ব্যবহার বেড়েছে। শাড়িতে আবদ্ধ নেই জামদানি। এখন সালোয়ার-কামিজ, জ্যাকেট, পাঞ্জাবি, কুর্তা, আসবাব, ব্যাগ, ঘরের পর্দায়ও জামদানির কাপড় ও নকশা স্থান পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, উদ্যোক্তারা গহনায়ও জামদানি নকশা ও মোটিফ ফুটিয়ে তুলছেন। গহনায় জামদানির মোটিফ নিয়ে কাজ করছেন সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরির স্বত্বাধিকারী লরা খান। তিনি জানান, দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে গহনায় জামদানির নকশা নিয়ে কাজ করছেন। কানের দুল, হাতের আংটি, গলার মালা, সীতাহার ইত্যাদিতে স্থান পাচ্ছে জামদানি নকশা। এসব গহনা এ সময়ের ফ্যাশন সচেতন নারী ও তরুণীরা বেছে নিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
লরা খান বলেন, ‘আমাদের ফিউশন ও ট্র্যাডিশনাল দুই ধরনের গহনা আছে। মেটাল, সোনা, পাথর, ডায়মন্ডসহ মোটামুটি সব ধরনের মেটালের গহনা আমরা তৈরি করি। আমাদের জামদানি পাড় সেট ও জামদানির অন্যান্য গহনা বেশ সাড়া ফেলেছে। জামদানি গহনাগুলো জামদানি শাড়ির কাজ দেখে করা হয়েছে।’
অন্দরসজ্জায় আজকাল জামদানির পণ্য ব্যবহৃত হয়। এমনকি কাঠের আসবাবেও জামদানি নকশা শোভা পাচ্ছে। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, আয়না, ক্যাবিনেটেও স্থান করে নিচ্ছে প্রিয় নকশা। স্টুডিও এনের ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট ফাতিমা বিনতে খালিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জামদানি কাপড় দিয়ে বিভিন্নভাবে ঘর সাজানো যায়। চাইলে সোফার কভার, সেন্টার টেবিলে জামদানি কাপড় ব্যবহার করা যায়। আবার ঘরের পর্দায়ও জামদানির কাপড় ব্যবহার করা যায়। তিনি জানান, ঘরের আসবাব, ক্যাবিনেটের পাল্লায় কাটিংয়ের সাহায্যেও জামদানির নকশা তোলা যায়।
এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ড জামদানির কাপড় দিয়ে তৈরি করছে বাহারি ব্যাগ। হ্যান্ডব্যাগ, পার্স, ক্লাচ ইত্যাদি সবই তৈরি হচ্ছে জামদানির কাপড়ে।
জামদানির যত্ন
জামদানির কারুকাজ, নকশা ও মিহি সুতার বুননের জন্য এটি সবার কাছে প্রিয় হলেও, এ শাড়ি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য বাড়তি যত্নের প্রয়োজন।
lজামদানি শাড়ি ভালো রাখতে কেনার পরপরই পাড়ে ফলস লাগিয়ে ফেলতে হবে। এতে হাঁটার সময় পাড় যেমন ভাঁজ হবে না, কুঁচি সুন্দর হবে আবার টান লেগে শাড়ি ছিঁড়ে যাবে না।
lজামদানি শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ কিংবা অন্যান্য পোশাক সাবান-পানিতে ধোয়া যাবে না। কেননা, জামদানি তৈরির সময় যে মাড় ব্যবহার করা হয়, তাতে পানি লাগলে সুতার বুনন আলগা হয়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। পানি লাগলে খুব দ্রুত জামদানি কাপড় নিস্তেজ হয়ে যায়।
lঅন্যান্য শাড়ির মতো জামদানি শাড়িতে ড্রাইওয়াশও করা যাবে না। শাড়ি ভালো রাখতে নির্দিষ্ট সময় পর কাটাওয়াশ করতে হবে। শাড়ি নষ্ট কিংবা ফ্যাকাশে হয়ে গেলেও, কাটাওয়াশে দিতে পারেন। কাটাওয়াশের জন্য যে কোনো লন্ড্রিতে শাড়ি না দিয়ে, কেবল যারা জামদানি বুনেন তাদের কাছে দিতে হবে। কেননা, একমাত্র যারা জামদানি তৈরি করেন তারাই ভালো করে কাটাওয়াশ করতে পারেন।
lদু-একবার পরার পর অনেকেই শাড়িটি আলমারিতে ফেলে রাখেন। দিনের পর দিন জামদানি শাড়ি আলমারিতে পড়ে থাকলে আঁশটে গন্ধ হয়। এজন্য মাঝেমধ্যে শাড়ি রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, শাড়ির দু’দিকেই যেন সমানভাবে রোদ লাগে।
lজামদানি শাড়ি কিংবা অন্যান্য পোশাক সরাসরি খুব কড়া রোদে দেওয়া যাবে না। কড়া রোদে জামদানি পোশাকের রং নষ্ট হয়। বারান্দা বা হালকা ছায়া আছে এমন স্থান জামদানি রোদে দিতে হবে।
lজামদানি শাড়ি অন্য শাড়ির নিচে রাখা ঠিক নয়। ভালো হয় সাদা কাগজের প্যাকেটে ভরে আলমারিতে তুলে রাখলে। এতে শাড়িতে ফাঙ্গাস পড়বে না। আবার মোটা পাইপ বা কাঠের লাঠির সঙ্গে পেঁচিয়ে রাখলে শাড়ির জমিন দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
lশাড়ি পরে বাইরে গেলে হুট করে আসা বৃষ্টিতে শাড়ি ভিজে গেলে বাসায় ফিরে তা রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
lব্যবহার শেষে জামদানি তুলে রাখার সময় শাড়ি ঠিকভাবে ভাঁজ করতে হবে। এ শাড়ি চার ভাঁজ করে মাঝখানে একটা ভাঁজ দিয়ে আরেক ভাঁজ ভেঙে রেখে দেওয়া যাবে না। এমনকি ভাঁজ করে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়েও রাখা যাবে না। প্রথমে অন্যান্য শাড়ির মতোই দুই ভাঁজ দিতে হবে। এর পর পাতালি ভাঁজ দিয়ে তার পর মাঝখানে ভেঙে একটা ভাঁজ দিয়ে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। কিছুদিন পরপর এই ভাঁজ পরিবর্তন করে রাখতে হবে। নয়তো দাগ পড়ে যেতে পারে।
lশাড়ির রং জ্বলে গেলে কিংবা নতুন করে রং করাতে চাইলে মনে রাখতে হবে, কেবল এক কালারের জামদানিগুলোতেই গাঢ় রং করা যায়। মাল্টিকালারের জামদানি শাড়িতে রং না করানো ভালো। v
ছবি সৌজন্য: অঞ্জন’স; কারুতন্ত্র ও সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি
- বিষয় :
- জামদানি