প্রচ্ছদ
সঙ্গী কতটা সমব্যথী

ফাইল ছবি
ফাতেমা তুজ জোহরা
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২২:২৭
সমব্যথী হওয়া মানে শুধু সঙ্গীর কষ্ট অনুভব করা নয়, বরং তাঁর অনুভূতির প্রতি সহানুভূতি দেখানো, তাঁর প্রয়োজনের প্রতি যত্নশীল থাকা, তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব দেওয়া, সর্বোপরি তাঁর পাশে থাকা। লিখেছেন ফাতেমা তুজ জোহরা
মানুষ সামাজিক জীব। চলার পথে মানুষের একজন সঙ্গী অপরিহার্য। একজন সঙ্গী তাঁর জীবনের প্রতিটি দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনার অংশীদার হয়। তাই সম্পর্কের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে উভয় সঙ্গীর সমব্যথী হওয়ার ক্ষমতার ওপর। সঙ্গীর সমব্যথী হওয়ার গুণাবলি একটি সুস্থ ও সুখী সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমব্যথী হওয়া মানে শুধু সঙ্গীর কষ্ট অনুভব করা নয়, বরং তাঁর অনুভূতির প্রতি সহানুভূতি দেখানো, তাঁর প্রয়োজনের প্রতি যত্নশীল থাকা, তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব দেওয়া, সর্বোপরি তাঁর পাশে থাকা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক লিজা আক্তার বলেন, ‘একজন মানুষ যখন তাঁর জীবনে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন, তখন তিনি চান তাঁর সঙ্গী তাঁকে মানসিকভাবে সহায়তা করুক, তাঁকে বুঝুক। এ সমব্যথার অভাব সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারে, যেখানে একে অপরকে ভালোভাবে বুঝতে না পারা এবং সহানুভূতির অভাবের কারণে ভুল বোঝাবুঝি ও ঝগড়া সৃষ্টি হয়।’
সঙ্গী সমব্যথী কিনা কীভাবে চিনবেন
সঙ্গী সমব্যথী কিনা তা বোঝার জন্য আপনি কিছু লক্ষণ লক্ষ্য করতে পারেন, যেমন–সমব্যথী সঙ্গী আপনার অনুভূতি ও চিন্তাধারা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন এবং আপনার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গে আপনাকে বলতে উৎসাহিত করবেন।
তবে তিনি শুধু আপনার কথা শুনে চুপ থাকবেন না, বরং আপনার সমস্যার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবেন। আপনার অবস্থান বুঝে সহানুভূতি জানাবেন। আপনি যখন কোনো দুঃখ, উদ্বেগ বা খুশির কথা তাঁকে বলবেন, তিনি সেই আবেগের প্রতিক্রিয়া জানাবেন। তিনি আপনার অনুভূতিগুলো গুরুত্ব দেবেন। সঙ্গী আপনার কষ্ট বা সমস্যায় পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করবেন, এমনকি সরাসরি সাহায্য করার সুযোগ না থাকলে অবশ্যই তিনি মানসিকভাবে সমর্থন জানাবেন।
তিনি আপনার ভুল বা দুর্বলতাগুলোকে বিচার না করে বুঝতে চেষ্টা করবেন এবং সেগুলো নিয়ে সমালোচনা করবেন না। কঠিন সময়ে তিনি আপনার পাশে থেকে মানসিক শক্তি জোগাবেন। তাঁর উপস্থিতি ও সহযোগিতা আপনাকে বোঝাবে, তিনি আপনার অনুভূতির প্রতি যত্নবান। এসব লক্ষণ একজন মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকলে ধরে নেওয়া যাবে, তিনি সঙ্গী হিসেবে সমব্যথী।
একজন সহমর্মী ও সমব্যথী মানুষ হতে হলে কী কী গুণ থাকতে হবে
একটি সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে সমব্যথা শুধু মানসিক সমর্থনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এর অর্থ শারীরিক এবং মানসিক সাহায্য প্রদান। অনেক সময় সঙ্গী তাঁর সমস্যা বা কষ্ট নিয়ে সরাসরি কিছু না বললেও একজন সমব্যথী সঙ্গী তাঁর মনোভাব ও আচরণ থেকে সমস্যা বুঝতে পারেন। এমনকি সেই মুহূর্তে তিনি কীভাবে সাহায্য করতে পারেন, সেটাও বুঝে নেন। একজন সহমর্মী ও সমব্যথী মানুষ হতে যেসব গুণ থাকা আবশ্যক, সে বিষয়ে বলেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোবিজ্ঞানী ড. হেলাল উদ্দিন আহমদ। তাঁর পরামর্শগুলো হলো–
সক্রিয়ভাবে শোনা: কোনো সম্পর্ককে গভীর করতে এবং সঙ্গীকে বোঝার প্রথম শর্ত হচ্ছে, তাঁর কথাগুলো সক্রিয়ভাবে শোনা। অনেক সময় আমরা সঙ্গীর কথা শুনি, কিন্তু আমরা মনোযোগ সহকারে শুনি না। এমন করলে সঙ্গী মনে করেন, তাঁর অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাই সঙ্গী যখন কোনো সমস্যা বা অনুভূতি শেয়ার করেন, তখন উচিত তাঁর কথাগুলো গুরুত্বসহকারে শোনা এবং তাঁর প্রতিক্রিয়া জানানো। এতে তিনি বুঝতে পারবেন, আপনি তাঁর অনুভূতির মূল্য দিচ্ছেন এবং তাঁকে সাহায্য করতে আগ্রহী।
আবেগগত সহায়তা প্রদান: কিছু সময় সঙ্গীর জন্য সবচেয়ে বড় সমর্থন হতে পারে তাঁর আবেগের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা। উদাহরণস্বরূপ, যদি সঙ্গী কোনো কারণে দুঃখিত হয়, তাঁকে বলুন, আপনি তাঁর দুঃখ বুঝতে পারছেন এবং তাঁর পাশে আছেন। অনেক সময় কোনো সমাধান বা উপদেশের প্রয়োজন নেই, শুধু তাঁর আবেগের প্রতি সমবেদনা দেখানোই যথেষ্ট ।
সমস্যার সমাধানে সাহায্য করুন: সমব্যথী হওয়া মানে শুধু আবেগগতভাবে সমর্থন দেওয়া নয়, বরং প্রয়োজন অনুযায়ী সঙ্গীকে বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধানে সাহায্য করা। এটি হতে পারে ছোটখাটো সমস্যা; যেমন ঘরের কাজ ভাগ করে নেওয়া বা বড় কোনো সিদ্ধান্তে তাঁকে পরামর্শ দেওয়া। সঙ্গীকে তাঁর সমস্যাগুলো একা মোকাবিলা করতে না দিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ালে তা তাঁর মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
সহানুভূতি ও সংবেদনশীল মনোভাব: সমব্যথার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সহানুভূতি। সঙ্গী যখন কোনো কষ্ট বা সমস্যার মধ্যে থাকে, তখন তাঁর মনোবল বাড়ানোর জন্য তাঁর সঙ্গে সহানুভূতিশীল আচরণ করা জরুরি। তাঁর আবেগের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে কথা বলুন এবং যে কথায় তাঁর কষ্ট আরও বাড়তে পারে, তা থেকে বিরত থাকুন।
সঙ্গীর অনুভূতি মূল্যায়ন: একটি সম্পর্কের স্থায়িত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঙ্গীর অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া। সঙ্গী যদি কোনো কিছু নিয়ে কষ্টে থাকে, এমনকি যদি সেই কষ্ট আপনার কাছে সামান্য মনে হয়, তবুও তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করুন। প্রত্যেকের অনুভূতির গভীরতা ভিন্ন হয়ে থাকে এবং একে অপরের অনুভূতির মূল্যায়ন করাই হলো একটি সম্পর্কের মূল ভিত্তি ।
মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করুন: সমব্যথা শুধু সম্পর্কের জন্যই নয়, মানসিক সুস্থতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। একজন সঙ্গী যখন মানসিকভাবে দুর্বল অবস্থায় থাকেন, তখন তাঁর পাশে দাঁড়ানো এবং সমব্যথী হওয়া তাঁকে মানসিক শান্তি এনে দেন। এতে তিনি মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং তাঁর সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারেন।
মনের গভীর সংযোগ তৈরি: সমব্যথার মাধ্যমে একে অপরের প্রতি গভীর সংযোগ তৈরি হয়। সঙ্গী যখন বুঝতে পারেন, তাঁর অনুভূতিগুলোকে সম্মান করা হচ্ছে, তখন সম্পর্কের মধ্যে গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এই সংযোগ সম্পর্ককে আরও মজবুত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থায়িত্ব আনে।
পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি: সমব্যথী সঙ্গী একজনকে মানসিক শান্তি ও আস্থা প্রদান করে। যখন একজন সঙ্গী বুঝতে পারেন তাঁর সঙ্গী তাঁর দুঃখ-কষ্টে পাশে থাকবেন এবং তাঁকে মানসিকভাবে সমর্থন দেবেন, তখন সম্পর্কের প্রতি আস্থা বেড়ে যায়। এই আস্থা সম্পর্ককে আরও স্থায়ী ও শক্তিশালী করে তোলে।
সম্পর্কে একে অপরকে বোঝা কতটা জরুরি
একটি সম্পর্কের ভিত্তি হলো বিশ্বাস, সম্মান ও সমঝোতা। তখনই সম্ভব যখন দু’জন মানুষ একে অপরকে সঠিকভাবে বুঝবেন। এটি সম্পর্কের স্থায়িত্ব এবং গভীরতা বৃদ্ধি করে। একে অপরের অনুভূতি, চাহিদা এবং চিন্তাভাবনা বোঝা না গেলে, ভুল বোঝাবুঝি, হতাশা এবং দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে। তাই সম্পর্ককে সফল ও সুখী করতে বোঝাপড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
সম্পর্কোন্নয়নে সমব্যথার ভূমিকা
একটি সফল ও সুস্থ সম্পর্কের জন্য শুধু ভালোবাসা ও আকর্ষণই যথেষ্ট নয়, বরং একে অপরের প্রতি দায়িত্ব এবং সমব্যথার গুরুত্ব অনেক বেশি। সময়ের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব হতে পারে এবং তখন সমব্যথী হওয়া একজন সঙ্গীকে সঠিকভাবে সাহায্য করতে পারে।
একটি সফল সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো, একে অপরের প্রতি সম্মান, ভালোবাসা এবং সমব্যথা। যদি কোনো সম্পর্কের মধ্যে সমব্যথা থাকে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি। সঙ্গীর সমব্যথী হওয়ার মানসিকতা শুধু সম্পর্কের উন্নতি ঘটায় না, বরং সঙ্গীর মানসিক সুস্থতাকেও প্রভাবিত করে, যা একটি সুখী ও স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের চাবিকাঠি। সঙ্গীর সমব্যথী হওয়া একটি সম্পর্কের সুস্থতা, স্থায়িত্ব এবং সুখের মূল উপাদান ।
সমব্যথী না হওয়ার অসুবিধা
সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব বেশি। অনেক পুরুষ তাঁর সঙ্গীকে ঠিকভাবে গুরুত্ব দেন না। সেই সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততা তাদের গ্রাস করে ফেলছে। ফলে সঙ্গীকে সময় দেওয়ার ব্যাপারটা তারা খুব একটা গুরুত্বসহকারে দেখেন না। এর প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। এসবের কারণেই অনৈতিক সম্পর্ক আর বিচ্ছেদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিয়ের পর বিশেষ করে নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা তাদের সঙ্গীকেই সব থেকে বেশি কাছের মানুষ বলে বিবেচনা করেন। স্বভাবতই তারা চান, সঙ্গী তাদের সব সুখ-দুঃখের ভাগিদার হোক। তা যদি না হয় তাহলে সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। আত্মবিশ্বাস কমে যায়, একাকিত্ব বোধ হয়। ফলে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। একসময় সম্পর্কের সুতা ছিঁড়ে যায়।
- বিষয় :
- পরিবার