কদম ফুলের রোদন

অলংকরণ:: দেওয়ান আতিকুর রহমান
জুয়েল আশরাফ
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫ | ০০:২৮
ট্রেন থামে আচমকা, যেন কোনো অদৃশ্য নির্দেশে। স্টেশনের নামটা ধরা যায় না শুরুতে। জানালার কাচে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা মুছে সাকান চোখ রাখে বাইরে। গাছপালা ঝাপসা হয়ে আছে। একটু দূরে, ভিজে ওঠা মাটির পাশ দিয়ে দুটো কদম গাছ মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে। পাতাগুলো যেন মাথা নিচু করে কোনো পুরোনো অপেক্ষার ভার বইছে।
সাকানের স্ত্রী লাবণী সঙ্গেই ছিল। কাপ থেকে চায়ের শেষ চুমুকটা নিয়ে সে বলে, ‘এই জায়গাটা কত শান্ত! দেখ না কদম গাছগুলো কেমন সুন্দর করে দাঁড়িয়ে আছে।’
সাকান তাকায়। গাছ দেখে না, সে দেখে স্টেশনের সাইন বোর্ডটা। জলে ভেজা কালো অক্ষরে লেখা নামটা তার ভেতরটাকে ঠান্ডা করে দেয়। নামটা খুব চেনা। ঠিক যেন বহু বছর আগে শোনা কোনো ডাকনামের মতো।
একটা পুরোনো কণ্ঠস্বর, বহু বছর আগের, খুব নিচু স্বরে তার কানে বাজে– ‘এই স্টেশন থেকে নামলেই পাবে কদম গাছের জোড়া, কদম ফুলে ভরে যায় বর্ষায়। ওখানে একটা পুরোনো মিষ্টির দোকান আছে। বাবা পছন্দ করতেন ওদের কালোজাম। তুমি এলে নিয়ে যেও, বাবার খুব ভালো লাগবে। জান, আমার ঘরের জানালা ঠিক ওই কদম গাছের দিকেই খোলে।’ সাকান থেমে যায়। ঝড়জলের শব্দের ভেতরেও কণ্ঠটা যেন স্পষ্ট শুনতে পায়। একটা মেয়ের কণ্ঠ। নামটা মনে পড়ে না, কিন্তু কণ্ঠটার মধ্যে যে ভবিষ্যৎটুকু ছিল, তা আজও বর্তমান।
সাকান তখন কলেজে, কোনো এক ট্রেনিংয়ের ছুতোয় অচেনা এক মফস্বল শহরে গিয়েছিল। আবছা মুখ, একটা লাল ছাতা আর ওই কণ্ঠ। মেয়েটি প্রতিদিন স্টেশনের কাছ দিয়ে হেঁটে যেত। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমার ঘর কি ওই কদম গাছগুলোর দিকেই?’
মেয়েটি হেসে বলেছিল, ‘হুম। তুমি যদি কোনোদিন ফিরে আস, এ কদম গাছের নিচেই দাঁড়িও। আমি জানালা দিয়ে দেখব। যদি দেখি তুমি মেরুন শার্ট পরে এসেছ, বুঝে নেব তুমি আমায় দেখতে আসনি।’ সেই কণ্ঠটি বারবার ফিরে আসে। কিন্তু সাকান কোনোদিন ফেরেনি। চাকরি, সংসার, দায়িত্ব সব একত্রে তাকে টেনে নিয়েছিল অন্যদিকে।
লাবণী বলে, ‘এই শহরটার একটা নরম গন্ধ আছে, না? বর্ষায় আরও বেশি মনে হয়।’
সাকান মাথা নাড়ে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাচ্চা মেয়ে, কাঁধে ছোট ব্যাগ। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চেয়ে আছে ট্রেনের দিকে। সাকানের মনে হয়, মেয়েটা যেন তারই কোনো গল্পের পাতার চরিত্র। ট্রেন হুইসেল দেয়। প্ল্যাটফর্মের ভেজা ছাউনি কাঁপে শব্দে। সাকানের কণ্ঠ থেমে আসে গলায়। লাবণী বলে, ‘জায়গাটা একটু ঘুরে দেখি।’
লাবণী তাকিয়ে থাকে। সাকানের চোখে সে কোনোদিন দেখেনি এমন নীরবতা। কিছুক্ষণ পর তারা নেমে পড়ে। স্টেশনের পাশের কাঁচা রাস্তা ধরে তারা যায় পুরোনো মিষ্টির দোকানটায়। দোকানের বুড়ো মালিক এখনও মনে রাখে, ‘আপনি আগে এসেছিলেন না? সেই... কদম গাছের সময়।’
সাকান চমকে তাকায়। দোকানদার হেসে বলে, ‘আমার সব পুরোনো ক্রেতা মনে থাকে। আপনার সঙ্গে এক মেয়ে ছিল...।’
এই মুহূর্তে সাকান বোঝে, সে যতই দূরে থাকুক, কিছু গল্প তার জন্য অপেক্ষা করে। কিছু ফুল শুধু বর্ষার জন্যই ফোটে আর কিছু চোখ, জানালার ওপাশ থেকে তাকিয়ে থাকে সারাজীবন।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে এক পুরোনো ব্যঞ্জনার মতো। সাকান জানে, এই বৃষ্টি তাকে আবার ফিরিয়ে এনেছে। হয়তো এবার সে ভুল করবে না। v
সুহৃদ ঢাকা
- বিষয় :
- সুহৃদ সমাবেশ