ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

জীবনের স্রোত

জীবনের স্রোত

ফাইল ছবি

তিন্নী অন্যুথা

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫ | ০০:৪০

রাহেলা বেগম, একজন সংগ্রামী মায়ের নাম। দুই মেয়েকে বুকে চেপে জীবনের প্রতিটি ঝড় ঠেলে সামনে এগিয়েছেন। এই গল্প কোনো কল্পনা নয়, বাস্তব জীবনের বর্ণনা। স্বামী আশরাফ আলি ছয় বছর আগে মারা যাওয়ার পর থেকে শুরু হয় তাঁর নিঃসঙ্গ লড়াই। তখন বড় মেয়ে ফারজানার বয়স দশ, আর ছোট মেয়ে অন্তু তখনও মায়ের গর্ভে। সেই মুহূর্ত থেকেই রাহেলার জীবনে নেমে আসে এক অন্ধকার অধ্যায়– থেমে যাননি তিনি। প্রতিটি দিন-রাত কাটিয়েছেন মেয়েদের সম্মানজনক ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুকে নিয়ে।
ছয় বছরে তিনি সহ্য করেছেন অনেক কুপ্রস্তাব, কটাক্ষ, অভাব আর অবহেলা। কোনো কিছুতেই টলেননি তিনি। তাঁর কাছে মেয়েরা ছিল জীবনের একমাত্র আশ্রয়। বড় মেয়ে ফারজানা এখন ১৬ বছরের কিশোরী। বিয়ের উপযুক্ত বয়সে পৌঁছালেও প্রতিটি প্রস্তাবের পেছনেই লুকিয়ে থাকে যৌতুকের দাবি। এসবের মোকাবিলা করতে গিয়ে রাহেলা নিজেই দুটি গরু কিনে পালতে শুরু করেন, মেয়ের বিয়ের খরচ জোগাড় করার আশায়। গরু দুটি ছিল তাঁর শেষ আশার প্রতীক।
প্রকৃতি কখনও কখনও মানুষের হিসাব-নিকাশ মানে না। ৮ দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টিতে চারপাশ ডুবে যায় পানিতে। তিন দিন আগে রাহেলার ঘরেও পানি ঢুকতে শুরু করে। প্রথমে না চাইলেও, প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হন ঘর ছেড়ে যেতে। গরুগুলোকেও সঙ্গে নিতে চাইলেও তারা পালিয়ে যায়। সেই সঙ্গে যেন রাহেলার স্বপ্নগুলোও ভেসে যায় বানের স্রোতে।
নৌকায় করে রাহেলা, ফারজানা, অন্তু ও কয়েকজন প্রতিবেশী আশ্রয়কেন্দ্রের পথে রওনা দেন। মাঝপথে স্রোতের তীব্রতায় ঘটে যায় জীবনের সবচেয়ে নির্মম ঘটনা—চার বছরের ছোট মেয়ে অন্তু পানির তোড়ে হারিয়ে যায় সবার চোখের সামনে। সেই মুহূর্তে রাহেলার বুক চিরে শূন্যতা গিলে নেয় তাঁর সমস্ত স্বপ্ন।
আশ্রয়কেন্দ্র এখন ঠিকানা। পাঁচতলা ভবনের তিন তলায় পড়ে আছেন রাহেলা বেগম। মাঝে মাঝে কেঁদে উঠছেন, আবার নিঃশব্দে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। তাঁর পাশে বসে থাকা ফারজানার চোখে জল নেই, কিন্তু চোখে এক ধরনের নিস্তব্ধ আর্তনাদ, যা ভাষায় বলা যায় না। আশ্রয়কেন্দ্রটিতে এখন শুধু মানুষ নয়, বসে আছে শত শত হারিয়ে ফেলা গল্প। তাদের আর কোনো প্রাপ্তি নেই, কেবল অপেক্ষা। খাবারও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। চারদিকে শুধুই পানি। যেন সেই পানিতে মিশে গেছে তাদের হাসি, ভালোবাসা, স্বপ্ন। রাহেলা বেগমের মতো আরও অসংখ্য মুখ। শিশুরা চুপ, বয়স্করা কাঁপা কণ্ঠে গল্প করে, আর হঠাৎ থেমে কান্নায় ভেঙে পড়ে। 
তবুও মানুষ আশায় বাঁচে। হোক তা অন্ধকারে একটি প্রদীপের মতো ক্ষীণ, তবুও সেই আলোই মানুষের জীবনের দিশা। হয়তো একদিন, কোনো নতুন সকাল রাহেলা বেগমের কণ্ঠে এনে দেবে সেই গর্বিত উচ্চারণ—আমার মেয়ে মানুষ হয়েছে, আমি হারিনি।” v
সুহৃদ, ঝিনাইদহ

আরও পড়ুন

×