নিত্যপণ্যের দরে জ্বলেপুড়ে বছর পার ভোক্তাদের

.
জসিম উদ্দিন বাদল
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৩ | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:৪৮
বিদায়ী ২০২৪ সালটি ঘটনাবহুল এক ঐতিহাসিক বছর। এ বছর দেশ শাসনের দায়িত্বে ছিল দুটি সরকার। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ঘিরে নিত্যপণ্যের বাজার যেন আকাশ ছুঁয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে ভোক্তাদের আশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার জিনিসপত্রের দর নাগালে আনতে পারবে। আদতে সেই চিত্র দেখা যায়নি। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে বেশ কিছু পণ্যে শুল্কছাড়সহ নানা সুবিধা দিয়েছে। তবুও সাধারণ ক্রেতারা আগের বছরের মতো বিদায়ী বছরটিও পার করেছেন নিত্যপণ্যের দরে জ্বলেপুড়ে।
বলা চলে কোনো কোনো পণ্যের দাম বাড়ার রেকর্ডের মধ্য দিয়েই বিদায় নিচ্ছে বহুল আলোচিত ২০২৪ সাল। ক্রেতাদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে চাল, ডিম, আলু, সবজি ও সয়াবিন তেলের মতো বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। দফায় দফায় দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকেই কাটছাঁট করেছেন বাজারের ফর্দে। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ কমিয়েছেন ভোগের পরিমাণ। আবার কেউ কেউ বেঁচে থাকার তাগিদে ছুটেছেন টিসিবি এবং ওএমএসের সাশ্রয়ী দরের পণ্যের ট্রাকের পেছনে। বাজার বেসামাল হওয়ায় দেশে দেখা গেছে টানা চড়া মূল্যস্ফীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন ভোক্তা-সাধারণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদায়ী বছরে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত। তাতে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি ছিল উত্তেজনাময়। ডলারের দামও বেড়ে ছিল অস্বাভাবিক। ফলে আমদানিকারকরাও কড়া হিসাবি ছিলেন আমদানির ক্ষেত্রে। তবে বছরের মাঝামাঝি সময়ে সরকার পতনের আন্দোলনে পণ্যের দর ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। নতুন সরকার গঠনের পর দেশের কয়েকটি জেলায় দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। তলিয়ে যায় ক্ষেতের ফসল, মাছ ও মুরগির খামার। তাতে সরবরাহ ব্যবস্থায় দেখা দেয় বড় বিপর্যয়। বাজার হয়ে পড়ে অনিয়ন্ত্রিত। এসব কারণে নতুন সরকারকে হিমশিম খেতে হয় বাজার সামলাতে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাজারে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এ উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে এখনই দেশি-বিদেশি উৎস থেকে পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে মজুত ঠিক রাখতে হবে। অন্যথায় আসন্ন রমজানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে।
আলোচনার শীর্ষে ছিল ডিম : বিদায়ী বছর আলোচনার শীর্ষে ছিল ডিমের বাজার। লাফিয়ে বেড়ে গত অক্টোবরে ফার্মের ডিমের ডজন ওঠে ১৮০ টাকায়। বাজারে লাগাম টানতে এক পর্যায়ে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে ডিমের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। পাশাপাশি ডিম আমদানির অনুমতি ও শুল্কছাড় দেওয়া হয়।
ভারত থেকে কয়েক দফায় কিছু ডিম আমদানি হয়। এর পর কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকে বাজার। ওই সময় দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীরা দায়ী করেছেন বন্যাকে। তাদের ভাষ্য ছিল, বন্যায় সব খামার ধ্বংস হয়ে গেছে। লাখ লাখ মুরগি মারা গেছে। এ কারণে ডিমের বাজার চড়া ওয়ে ওঠে। যদিও এখন পতন ঘটেছে দামে। গতকাল শুক্রবার প্রতি ডজন বিক্রি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা দরে। ডিমের সঙ্গে উত্তাপ ছড়িয়েছে মুরগির বাজারও। ব্রয়লারের কেজি এখনও বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা দামে।
যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাড়তি এ দাম বেশিদিন টিকবে না। ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ উপলক্ষে শহরজুড়ে নানা আয়োজন থাকে। সে জন্য এ সময় দাম বেড়ে যায়।
শতক ছুঁয়েছিল বেশির ভাগ সবজির দাম : ডিমের দাম এভাবে বাড়ার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে সবজি। এ বছর রেকর্ড গড়েছিল সবজির বাজার। এমন কোনো সবজি নেই, যার দাম বাড়েনি। স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার গুণ দাম বাড়ে সবজির। বিশেষ করে জুলাইয়ের শেষদিকে বেশির ভাগ সবজির দাম শতক পেরিয়ে যায়। যেমন– প্রতি কেজি উচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, বরবটি ও কচুরমুখী ১০০ থেকে ১১০, বেগুন ১৪০ থেকে ১৫০, কাঁকরোল ৯০ থেকে ১০০, গাজর ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা ও মুলা ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এভাবে প্রায় সব সবজির দাম এক প্রকার আকাশ ছুঁয়েছিল। তখন সবজি ব্যবসায়ীদের যুক্তি ছিল, টানা বৃষ্টিতে সবজি গাছ মরে গেছে। পাশাপাশি কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরবরাহ কমে গেছে। এ জন্য সবজির দাম বাড়ছে।
আলুর বাজারও কম আলোচনার জন্ম দেয়নি। ডিম-সবজির মতো পণ্যটির দামও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছায়। বছরের বেশির ভাগ সময় ৬০ টাকার আশপাশে ছিল আলুর কেজি। তবে গত নভেম্বরে এক পর্যায়ে ৮০ টাকাও ছুঁয়েছে দাম। ডিমের পাশাপাশি আলুও আমদানি হয়েছিল ভারত থেকে। এখন নতুন আলু উঠতে শুরু করেছে। দামও কমে ৪০ টাকায় নেমেছে।
ঘাম ঝরিয়েছে চালের বাজার : গত জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের কিছুদিন পরই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে চালের বাজার। ফেব্রুয়ারি-মার্চে চালের বাজার ঘাম ঝরিয়েছে ক্রেতার। জুনে কিছুটা কমে। আগস্টে ফের চড়তে থাকে দাম। নভেম্বরের কিছুটা কমে এখন ফের ঊর্ধ্বমুখী। এভাবে উত্থান-পতনে এবার চিকন চালের কেজি সর্বোচ্চ ৭৫ টাকা, মাঝারি চালের কেজি ৬৫ এবং মোটা চালের কেজি ৫৬ টাকায় উঠেছে। মাঝারি ও মোটা চালের দাম কিছুটা কমলেও চড়া রয়ে গেছে চিকন চালের দাম।
কিছু সময়জুড়ে ভোক্তার চোখের পানি ঝরিয়েছে কাঁচামরিচ। সরকার পতনের আন্দোলনের কারণে সরবরাহ সংকটের অজুহাতে জুলাই মাসের শুরুতে ঢাকায় সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় কেজি বিক্রি হয়েছে মরিচের কেজি। শেষ পর্যন্ত সরকারের নীতি সহায়তায় আমদানি হতে শুরু করলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে। এখন দরে ব্যাপক পতন ঘটেছে। কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৭০ টাকা দরে।
শুল্ক ছাড়েও তেলেসমাতি ভোজ্যতেলে : বছরের শেষদিকে রীতিমতো তেলেসমাতি কাণ্ড ভোজ্যতেলের বাজারে। শুল্ক ছাড়ের পরও বিশ্ববাজারে দর বাড়ার অজুহাতে দাম বাড়ান আমদানিকারকরা। দাম বাড়ানোর আগে কয়েকদিনের জন্য বাজার থেকে এক প্রকার উধাও হয়ে যায় বোতলজাত সয়াবিন তেল। বাড়তি দরে বিক্রি হয় খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েল। সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে দাম বাড়ানোর ঘোষণার দিনই বাজার ভরে গেছে লুকানো তেলে।
মূল্যস্ফীতি ছিল উদ্বেজনক : পণ্যের দর বেড়ে যাওয়ায় বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি ছিল উদ্বেজনক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে অনুযায়ী, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে নভেম্বরেও সারাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অক্টোবরে যা ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে যায়। আগস্টে কিছুটা কমে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ হয়। সেপ্টেম্বরে আরও কিছুটা কমে হয় ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মাস এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। টানা প্রায় আড়াই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে।
দাম কমার ঘটনাও আছে : তবে দাম বাড়ার এত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে কমার ঘটনাও রয়েছে। অন্য বছরের তুলনায় এবার বেসামাল হতে পারেনি পেঁয়াজের বাজার। ভারত রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মাঝামাঝি এক দিনেই ১০০ টাকার মতো বেড়ে কেজি ছুঁয়েছিল ২৫০ টাকা। এবার সেই পরিস্থিতি দেখা যায়নি। সর্বোচ্চ ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যদিও দাম কমে এখন ৫০ টাকায় নেমেছে। একইভাবে ওই বছর গরুর মাংসের কেজি ৮০০ টাকা পার হলেও এবার সর্বোচ্চ উঠেছে ৭৫০ টাকা। এ ছাড়া ডালের দামও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। স্বাভাবিক ছিল মাছের বাজারও। দাম কমেছে আটার।
আমদানিতে ব্যাপক শুল্ক ছাড় : বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ ঠিক রাখতে নতুন সরকার গত সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়। সেপ্টেম্বরে আলু আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ ও বিদ্যমান ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। চাল আমদানিতে মোট শুল্ককর ছিল ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ। গত অক্টোবরে আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি আগাম কর পুরোটাই প্রত্যাহার করা হয়। একই মাসে ডিম আমদানিতে শুল্কহার ২৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় মাত্র ৫ শতাংশ। পাশাপাশি অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। ভোজ্যতেল আমদানিতেও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। সর্বশেষ নভেম্বরে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয় পেঁয়াজে। পণ্যটি আমদানিতে শুল্ক-কর সম্পূর্ণভাবে মওকুফ করা হয়।
সাশ্রয়ী দামে বিক্রির উদ্যোগ : শুল্ককর কর কমানোর পাশাপাশি বছরজুড়ে খোলাবাজারে ভর্তুকি মূল্যে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেছে সরকার। এর মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবি চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, আলু এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় চাল ও আটা বিক্রি করেছে। গত অক্টোবরে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সাশ্রয়ী মূল্যে আলু, ডিম, পেঁয়াজসহ কয়েকটি সবজি বিক্রি করেছে।
অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ : সার্বিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক সমকালকে বলেন, নিত্যপণ্যের এমন দামে প্রমাণিত হয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ছাড় যথেষ্ট উদ্যোগ নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো জরুরি। তবে নিম্ন রিজার্ভ পরিস্থিতির মধ্যে বেশি আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়ানোও কিন্তু সহজ বিকল্প নয়।
তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির চাপ যাতে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়, সে জন্য রমজান মাসে সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা এখনই করতে হবে। দরিদ্র ও দুর্বলদের সাহায্য করার জন্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষার আওতা আরও বাড়াতে হবে।
- বিষয় :
- নিত্যপণ্যের দাম