ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

যেভাবে সৌদির বাংলাবাজার জয় করল হাফিজুরের মুড়ি

যেভাবে সৌদির বাংলাবাজার জয় করল হাফিজুরের মুড়ি

শপআপের নতুন চ্যানেল ব্যবহার করে সাড়ে ১৯ টন মুড়ি সৌদি নিয়েছেন তিনি

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ২৩:৩২

সতেরো বছর আগে সৌদি আরবে পাড়ি জমান নোয়াখালীর হাফিজুর রহমান। আর দশজন অভিবাসীর মতোই সীমিত আয় দিয়ে প্রবাসজীবন শুরু করেন তিনি। ভাগ্য বদলের যাত্রা নতুন দিকে মোড় নেয় দ্রুতই। বছর দুয়েকের মাঝে ভাতিজা মাহমুদের সহায়তায় হাফিজুর গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি মুদি দোকান। দীর্ঘ ১৫ বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর সেই দোকান আজ রূপ নিয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ সুপারশপে। উপমহাদেশীয় পণ্যের বড় সংগ্রহ থাকায় রিয়াদের বাংলাবাজারে অবস্থিত সুপারশপটি এরই মধ্যে বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি অভিবাসীদের একটি পছন্দের গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। 
ব্যবসা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাফিজুর লক্ষ্য করেন সৌদিতে বাংলাদেশি অনেক পণ্যের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ একেবারেই অপ্রতুল। তাই পর্যাপ্ত উপমহাদেশীয় ক্রেতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর দোকানের তাক ভর্তি থাকত সৌদি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি পণ্যে। 
বড় বাংলাদেশি ব্র্যান্ডগুলোর সৌদির বাজারে প্রবেশের আগে এটিই ছিল রিয়াদের এফএমসিজি বা ভোগ্যপণ্যের বাজারের চিত্র। সময়ের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশের বড় কোম্পানিগুলোই এই বাজারে জায়গা করে নিতে পেরেছে। মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পণ্য চাহিদা সত্ত্বেও অনেকটাই অনুপস্থিত। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে হাফিজুর দেখতে পান রপ্তানিতে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও জটিল রপ্তানি অবকাঠামোই এর পেছনে দায়ী। 
এসব সমস্যা হাফিজুর আরও প্রকটভাবে অনুভব করেন যখন তিনি নিজেই বাংলাদেশ থেকে সৌদিতে মুড়ি রপ্তানি করতে যান। রপ্তানি প্রক্রিয়ায় পদে পদে হোঁচট খেতে হয় তাঁকে। এলসি খোলা, বন্দরের কার্যক্রম, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সবকিছুই তাঁর কাছে এক দুর্বোধ্য জটিল প্রক্রিয়া বলে মনে হয়। হতাশ হয়ে পড়েন হাফিজুর। গল্পের মোড় ঘুরে যায় যখন হাফিজুর পরিচিত হন বিটুবি (বিজনেস টু বিজনেস) সাপ্লাই চেইন প্ল্যাটফর্ম শপআপের সঙ্গে। মূলত বাংলাদেশের ভেতরে খাদ্যপণ্য, মুদি সামগ্রী ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে থাকলেও নিজেদের সরবরাহ সক্ষমতা সম্প্রতি দেশের সীমানার বাইরেও বিস্তৃত করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানটি। সৌদি আরবভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউশন ফার্ম ‘সারি’ শপআপের সঙ্গে একীভূত হয়ে গঠন করেছে সিল্ক, যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন আন্তর্জাতিক ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল। শপআপের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ চ্যানেল ব্যবহার করে অনেক বাংলাদেশি পণ্যই এখন পৌঁছে যাচ্ছে সরাসরি সৌদির বিভিন্ন দোকানে।
এ সুযোগ লুফে নেন হাফিজুর। শপআপের নতুন চ্যানেল ব্যবহার করে এলসিসহ অন্যান্য কাস্টমস ও রপ্তানিসংক্রান্ত জটিলতা ছাড়াই বিগত রমজানে ছয় কনটেইনার বোঝাই সাড়ে ১৯ টন মুড়ি সৌদি আরবে পৌঁছাতে সক্ষম হন তিনি। নোয়াখালী থেকে সংগৃহীত মুড়ি ব্র্যান্ডিং ও প্যাকেজিং করেন বড় ছেলে ‘আনাস’-এর নামে। সৌভাগ্যক্রমে খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর মুড়ি। নিজের শপ ছাড়াও রিয়াদের অন্যান্য সুপারশপ ও মুদি দোকানেও শুরু করেন সরবরাহ। 
হাফিজুর বলেন, ‘সৌদির বাজারে সব সময়ই বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা ছিল, কারণ এখানে প্রচুর বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছেন। আমাদের মুড়ি এখানে জনপ্রিয় হয়েছে। আমি ভবিষ্যতে আরও পণ্য আনব যেন আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরা এখানে বসে দেশের স্বাদ পেতে পারেন। তিনি বলেন, ‘যখন প্রথম রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু করি, কিছুই বুঝতাম না। অনেক হতাশ ছিলাম। শপআপ পুরো প্রক্রিয়া খুব সহজ করে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমার মতো অনেক ছোট ব্যবসায়ীর উপকার হবে এই সেবায়।’
মুড়ি বিক্রি করে জনপ্রিয়তা পেলেও এখন কেবল মুড়িতে সীমাবদ্ধ থাকতে চান না হাফিজুর। বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক ও মৌসুমি নানান পণ্য যেমন– পানপাতা, খেজুরের গুড়, দেশি ফল ইত্যাদিও সৌদির বাজারে আনতে চান তিনি। প্রবাসীদের মাঝে এসব পণ্যের চাহিদা থাকলেও পচনশীল হওয়ার কারণে এতদিন সেভাবে সৌদির বাজারে পৌঁছতে পারেনি। সারির আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইন নেটওয়ার্ক এখন সেই স্বপ্ন দেখাচ্ছে হাফিজুরকে।
হাফিজুরের এ সফলতা শুধু বাংলাদেশি পণ্য মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেনি, পাশাপাশি বিশ্ববাজারে আমাদের দেশীয় পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ে উন্মোচন করেছে এক নতুন দিগন্ত। দেশের মাটিতে ফলানো কৃষকের কষ্টের ফসল যখন বিদেশের মাটিতে প্রবাসীর মুখে হাসি ফোটায়, তখন তা ব্যবসা ছাপিয়ে হয়ে ওঠে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশি পণ্যের গর্বিত পথচলার গল্প।

আরও পড়ুন

×