এলডিসি থেকে উত্তরণ
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত দেশের ওষুধশিল্প

কোলাজ
আনোয়ার ইব্রাহীম
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ২৩:৪৬
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ওষুধ খাত ছিল প্রায় পুরোটাই বহুজাতিক কোম্পানি ও আমদানিনির্ভর। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকা দামি ওষুধ আমদানি করা হতো মূলত ভারত, পাকিস্তান ও ইউরোপ থেকে। সেই সময় দেশীয় উদ্যোগে ওষুধ উৎপাদন ছিল সীমিত, গুণগত মানও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আশির দশকের শুরুর দিকে ওষুধ খাতে আমূল পরিবর্তন আনে ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি। এতে বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া দাপট কমে আসে, গুণগত মান ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশীয় কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে আস্থা অর্জন করতে থাকে। গত চার দশকে দেশে ওষুধের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় সম্পূর্ণটাই স্থানীয়ভাবে পূরণ হচ্ছে। একই সঙ্গে এ খাত রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবেও বিকশিত হয়েছে।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এই উত্তরণ বড় অর্জন হলেও এতে বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের জন্য নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। এলডিসি মর্যাদার কারণে বাংলাদেশ এতদিন ট্রিপস চুক্তির আওতায় ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যে পেটেন্ট সংরক্ষণ থেকে অব্যাহতি পেত। ফলে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো পেটেন্ট না থাকা সত্ত্বেও উদ্ভাবনী ওষুধের জেনেরিক সংস্করণ তৈরি ও বিক্রি করতে পারত। যে কারণে দেশের জনস্বাস্থ্য, ওষুধের দাম এবং রপ্তানি সক্ষমতায় সহায়ক হয়েছে।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর পরবর্তী সর্বোচ্চ তিন বছর এ সুবিধা ভোগ করতে পারবে বাংলাদেশ। অর্থাৎ ২০২৯ সাল থেকে পেটেন্ট সুরক্ষা বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে। তখন আর কোনো বিদেশি কোম্পানির অনুমতি ছাড়া উদ্ভাবনী ওষুধ তৈরি সম্ভব হবে না। পেটেন্টধারীদের রয়্যালটি দিতে হবে, যার পরিমাণ হতে পারে প্রতি পণ্যে ৩০ থেকে ৫০ লাখ ডলার পর্যন্ত। এতে উৎপাদন ব্যয় ও রপ্তানি প্রতিযোগিতা–দুই ক্ষেত্রেই বড় ধাক্কা আসবে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, জেনেরিক ওষুধের বাজার সংকুচিত হবে এবং রপ্তানিতেও প্রভাব পড়ার শঙ্কা আছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ড. মো. আকতার হোসেন জানান, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন একটি বাস্তবতা। এ কারণে ওষুধ খাত যে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, সে বিষয়ে সরকার সচেতন আছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ওষুধ উদ্ভাবনে গবেষণা কম হয়। ফলে যতদিন না নিজেরা ওষুধ উদ্ভাবনে সক্ষম হব, ততদিন অন্য দেশের পেটেন্ট করা দেশে প্রস্তুতের জন্য আমাদের রয়্যালিটি দিতে হবে। এতে ওষুধের উৎপাদন ব্যয় কিছুটা বাড়বে– এটি সত্যি।
আকতার হোসেন আরও বলেন, এই খরচ কমাতে পারি যদি ওষুধ প্রস্তুতের কাঁচামালে আমদানি নির্ভরতা কমাতে এবং তা দেশেই প্রস্তুত করতে পারি। তবে ওষুধ খাতে এখনও বড় সীমাবদ্ধতা হলো–অধিকাংশ কাঁচামাল বা সক্রিয় উপাদান এপিআইর আমদানি নির্ভরতা। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় সরকার এপিআই পার্ক স্থাপন করেছে। এখানে ২৬টি প্লট আছে, তার মধ্যে মাত্র চারটি প্লট বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। সরকার চায় এখানে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে এগিয়ে আসুন। এক্ষেত্রে যেসব অনুমোদনের ইস্যু আছে, তা দ্রুততর করতে প্রস্তুত আছে ঔষধ প্রশাসন।
এমন বাস্তবতায় খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই রূপান্তরজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ওষুধশিল্প এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রস্তুত নয়। গবেষণা, উদ্ভাবন, কাঁচামাল উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দূরদর্শী হতে হবে। নিজেদের ওষুধ উদ্ভাবন করতে হবে। এক্ষেত্রে গবেষণা নেই বললেই চলে।
জানতে চাইলে ওষুধশিল্প সমিতির সভাপতি ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মুক্তাদির সমকালকে বলেন, ‘এত বড় একটা চ্যালেঞ্জ সামনে, অথচ এর জন্য আমরা যথেষ্ট প্রস্তুত নই। গত এক বছরে আসলে কিছুই হয়নি। সামনে মাত্র একটা বছর আছে।’
আব্দুল মুক্তাদির বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যত ওষুধ উদ্ভাবন হয়েছে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আগে সেগুলোর রেজিস্ট্রেশন করে রাখা দরকার। অথচ ঔষধ প্রশাসনের এ-সংক্রান্ত কমিটির গত দেড়-দুই বছর ধরে মিটিংই হয়নি। এপিআই পার্ক হয়েছে, কিন্তু গ্যাস সংযোগ নেই। ফলে পার্ক পার্কের মতো পড়ে আছে। আশার কথা, সরকার একটি সভা ডেকেছে। আশা করছি, সেখানে এসব বিষয়ে আলোচনা হবে এবং যেসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি, সেগুলো সমাধানে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ওষুধশিল্প: এক বিস্ময়কর রূপান্তরের গল্প
দেশে বর্তমানে ২৮৪টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি নিবন্ধিত, যার মধ্যে ২২৯টি সক্রিয়ভাবে উৎপাদনে রয়েছে। চাহিদার ৯৮ শতাংশই জোগান দেয় এসব কোম্পানি। এ বাজারের প্রায় ৭১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে শীর্ষ ১০টি কোম্পানি। এর মধ্যে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো, রেনাটা, অপসনিন, এসকেয়ার, হেলথকেয়ার অন্যতম। বড় কোম্পানিগুলো আধুনিক প্রযুক্তি, গবেষণায় বিনিয়োগ এবং বিস্তৃত বিতরণ কাঠামোর মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। ছোট-মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে আছে নির্দিষ্ট থেরাপিউটিক শ্রেণিতে, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক বা ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ।
১৯৮২ সালের ওষুধনীতির মাধ্যমে ১৭৭টি অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয় এবং ১১৭টি মৌলিক ওষুধের একটি জাতীয় তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এই নীতির প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (প্রয়াত)।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১০ সালে ওষুধশিল্পের বাজার ছিল প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার, যা ২০২৪ সালে পৌঁছেছে সাড়ে ৪২ হাজার কোটিতে, ইউএস ডলারে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন। গত এক দশকে এই খাতের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১০-১৪ শতাংশ।
রপ্তানিতে দৃশ্যমান অগ্রগতি
বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রপ্তানি শুরু হয় ১৯৮৭ সালে, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস-এর মাধ্যমে। তখন প্রধান গন্তব্য ছিল মিয়ানমার ও আফ্রিকার কিছু দেশ। ২০১৫ সালে বেক্সিমকো যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রপ্তানির মাধ্যমে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এরপর স্কয়ার, ইনসেপ্টা এবং রেডিয়েন্টও এ বাজারে প্রবেশ করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানির আয় ছিল ২১ কোটি ৩২ লাখ ডলার, যা মোট পণ্য রপ্তানির ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। এই হার ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশ ১৫৬টির বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। শীর্ষ ১০টি গন্তব্য হলো– মিয়ানমার, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, কেনিয়া, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও নেপাল।
সামনে চ্যালেঞ্জ, প্রস্তুতির ঘাটতি
দেশীয় কোম্পানিগুলো এতদিন পেটেন্ট ছাড়ের সুবিধায় যে জেনেরিক ওষুধ তৈরি করে এসেছে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর তা আর সম্ভব হবে না। তখন পেটেন্টপ্রাপ্ত ওষুধ উৎপাদনের জন্য রয়্যালটি দিতে হবে বা লাইসেন্স নিতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা কমবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখন থেকেই উদ্ভাবিত ওষুধগুলোর নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে।
ডেল্টা ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন সমকালকে বলেন, ‘গ্র্যাজুয়েশনের আগেই যত ওষুধ নিবন্ধন করা যাবে, ততই লাভ। কারণ, পেটেন্ট আসার পরও রেজিস্টার্ড পণ্যের ১৫ বছর পর্যন্ত উৎপাদন করা যাবে।’ সমস্যাটা হলো, দুই বছর ধরে ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদন কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি। প্রায় ৫০০ ওষুধ নিবন্ধনের অপেক্ষায় আছে।
কাঁচামালেই মূল দুর্বলতা
বাংলাদেশের ওষুধশিল্প এখনও ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ সক্রিয় উপাদান (এপিআই) আমদানি করে, যার বড় অংশ আসে চীন ও ভারত থেকে। এই নির্ভরতা শুধু দামের ওপর চাপই বাড়ায় না, সরবরাহ ঝুঁকিও বাড়ায়। গজারিয়ায় নির্মিত এপিআই পার্কে এখনও মাত্র ৪টি কোম্পানি কারখানা স্থাপন করেছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জটিলতার কারণে এ প্রকল্প পুরোপুরি সচল হয়নি।
প্রণোদনা ছাড়া রপ্তানি ধাক্কা খেতে পারে
এলডিসি অবস্থায় বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানিতে ভর্তুকি দিতে পারত। গ্র্যাজুয়েশনের পর সেই সুযোগ থাকবে না। এতে রপ্তানি আয় ৬-৭ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রপ্তানিকারকদের জন্য কর ছাড়, গবেষণা সহায়তা এবং বিকল্প প্রণোদনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা।
সক্রিয় হতে হবে নীতিনির্ধারকদের
বিশ্লেষকদের মতে, ওষুধশিল্পে বাংলাদেশের এই অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে বড় অবদান ছিল সময়োপযোগী নীতিমালার। নতুন বাস্তবতায়ও তেমনি এক সুসংহত নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। এখন দরকার, দ্রুত ওষুধ নিবন্ধন প্রক্রিয়া সচল করা, এপিআই পার্ক সম্পূর্ণভাবে চালু করা, গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো, আন্তর্জাতিক গুণগত মান রক্ষা, বায়োফার্মার মতো ভবিষ্যৎ খাতকে উৎসাহিত করা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দরিদ্রবান্ধব প্রণোদনা নিশ্চিত করা।
ওষুধশিল্প সমিতির সভাপতি আব্দুল মুক্তাদির বলেন, গত তিন থেকে চার দশক ধরে যে শিল্প গড়ে উঠেছে তা এগিয়ে নিতে হবে। চ্যালেঞ্জ সব সময়ই আসবে। তবে তা মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের এখন চ্যালেঞ্জ এপিআই, গবেষণা এবং জনবল সৃষ্টি। এই তিন ক্ষেত্রেই আশির দশকের মতো সরকারের সক্রিয় নীতিসহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
- বিষয় :
- ওষুধ