ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকারে যতীন সরকার

স্বাধীনতার চেয়ে বড় কিছু নেই

শৃঙ্খলমুক্তির দিন, বিজয়ের দিন

স্বাধীনতার চেয়ে বড় কিছু নেই

যতীন সরকার

হামিম কামাল

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৩২ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫:৪৮

আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। স্বাধীনতার চেয়ে বড় কিছু নেই। কিন্তু এ কথা বলতেই হবে, আমাদের পুরোনো চার মূলনীতি আগেও সুষ্ঠুভাবে অর্জিত হয়নি। নতুন বাস্তবতায়ও কতখানি হবে, তা নিয়ে হয়তো ভাবনার অবকাশ আছে। তবে আজকের পরিণতির পেছনে প্রধানত দায়ী গণতন্ত্রহীনতা বাংলাদেশের প্রগতিশীল মননশীল সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্বদের অন্যতম যতীন সরকার। বিজয় দিবসের ৫৪ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে আলাপ হয় সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হামিম কামাল

সমকাল: কেমন আছেন?

যতীন সরকার: বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভীষণ অসুস্থ বোধ করছি। মনে হচ্ছে, এর কোনো উপশম নেই।

সমকাল: শুভকামনা আপনার জন্য। আশা করছি, উপশম হবে। বাংলাদেশ বিজয়ের ৫৪ বছরে পদার্পণ করেছে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের কোনো বিশেষ স্মৃতি কি আপনার মনে পড়ে?

যতীন সরকার: অনেক ঘটনা বিস্মৃত হয়েছি। যতদূর মনে আছে, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমরা ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ছিলাম। সেই সময়ে নানান কারণে আমাদের পরিবার তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমার অংশের পরিবার নিয়ে আমরা প্রায় ১০ মাস মেঘালয়ে অবস্থান করি। এ মুহূর্তে শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ থাকায় অনেক ঘটনাই হয়তো স্মরণ করতে পারব না। তবে এটুকু মনে আছে, বিজয়ের সংবাদ আমরা মেঘালয়ে বসে শুনেছি এবং অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে সেই সংবাদ আমরা গ্রহণ করেছি, সেই সময়টাকে উপভোগ করেছি। এ পর্যায়ে একটু পেছন ফিরে দেখা যায়। ব্রিটিশরাজের অধীনে আমরা প্রায় দুইশ বছর কাটিয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের অধিবাসী হয়েছিলাম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মোহভঙ্গ হলো এবং আমরা বুঝতে পারলাম, এই পাকিস্তান আমাদের জন্য মোটেই সত্যিকার স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। পাকিস্তানের তথাকথিত জাতির পিতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন বলেছিলেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা– তাঁর কথা থেকেই আমরা বুঝে নিতে পেরেছিলাম, বাঙালিরা সব দিক থেকেই প্রতারিত হয়েছে এবং শোষণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কৌশলে মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কাজেই ভাষার আন্দোলনে নেমে আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে উপনীত হয়েছিলাম এবং সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাত ধরেই আমরা ক্রমশ সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হলাম। যার মধ্য দিয়েই ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমরা পেলাম আমাদের বাংলাদেশ।

সমকাল: বিজয় এত দ্রুত অর্জিত হবে, তা কি ভাবতে পেরেছিলেন?

যতীন সরকার: ১৬ ডিসেম্বরেই যে বিজয় আসবে, আমরা তা ভাবতে পারিনি। ১০ মাসের মধ্যে স্বাধীনতা চলে আসার বিষয়টি আমাদের জন্যে বিস্ময়ের ছিল। চার-পাঁচ দিন পর আমরা বাংলাদেশে, ময়মনসিংহে ফিরে আসি। ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে আমি শিক্ষকতা করতাম। মনে আছে, ২০ ডিসেম্বর আমি ময়মনসিংহে পা রেখেছিলাম।

সমকাল: ময়মনসিংহে পা রেখে প্রথম কী প্রতিক্রিয়া হলো? বিশেষ কোনো পরিবেশ, পরিস্থিতি মনে দাগ রেখাপাত করেছিল? কোনো সম্ভাবনা, কোনো প্রতিজ্ঞা?

যতীন সরকার: ময়মনসিংহে পা রেখে দেখি, যাদের প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে চিনতাম, যারা গোটা সময় পাকিস্তানের পতাকাবাহী ছিল তো বটেই, সর্বতোভাবে পাকিস্তানের সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এর প্রয়োজনে মানুষের ওপর নির্যাতন চালানোরও পক্ষপাতী ছিল। তারা হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা যোদ্ধা হয়ে উঠেছে। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি, পট বদলের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করতে থাকে, ১৬ ডিসেম্বরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে থাকে।

সমকাল: কিন্তু এই ছদ্মবেশী মানুষগুলো বাংলাদেশের মূলনীতিতে আদৌ বিশ্বাসী ছিল না। তাদের কোনো মৌলিক পরিবর্তন কি ঘটেছিল পরবর্তীতে?

যতীন সরকার: স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতি নির্ধারিত হয়েছিল– জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা। স্বাধীনতার তৃতীয় বছরে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এলো, তারা কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে লোপাট করে দিল, আর দেশে পাকিস্তানের ভূত আবার ফিরে এলো এবং এই সময়ে যারা প্রগতিশীল সেজেছিল, তাদের অনেকে স্বরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছে। দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হলেও পাকিস্তানের ভূত আমরা আর তাড়াতে পারি নাই।

সমকাল: এর কোন লক্ষণটা সবচেয়ে স্পষ্ট?

যতীন সরকার: বরাবর আমার বাম ঘরানার রাজনৈতিক আদর্শিক রাজনীতির সঙ্গে গভীর সংশ্লিষ্টতা ছিল। মেঘালয়ে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বৈঠক, পাঠচক্র আয়োজিত হতো। অনেকেই সেখানে ছিলেন, অনেকের সঙ্গে আমিও ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর দ্রুত আসবে তা জানা না থাকলেও, বিজয় যে আসবে তা আমাদের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত ছিল। ময়মনসিংহে পা রেখে যা দেখেছিলাম, প্রতিক্রিয়াশীলদের রাতারাতি ছদ্মবেশী প্রগতিশীল হয়ে ওঠা, তা আমার জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক ছিল। আমার মনে নতুন কিছু চিন্তার উন্মেষ ঘটেছিল। এ কথাই বারবার মনে হচ্ছিল, এদের অনেকের প্রকৃত পরিচয়ই আমার জানা আছে। সময়ে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এরা যে কী করবে, তা বলা বড় কঠিন। এখনও রাষ্ট্রনীতিতে একটি বিশেষ ধর্মের, ইসলাম ধর্মের প্রাধান্য বিদ্যমান। আজ অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পর বলতে পারি, অর্জনের পাশাপাশি আমরা বহু কিছু হারিয়েছি। বর্তমান বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলছে, যার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নতুন এই প্রেক্ষাপট নির্মাণে তাঁর অবদান কী, আমার মনে প্রশ্ন জাগে।

সমকাল: আপনি বরাবরই রাজনীতিতে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা বলেছেন...

যতীন সরকার: আমার যখন ৫০ বছর বয়স, সেই সময়ে আমার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বইটির নাম সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা। মেঘালয়ের স্মৃতির সূত্রে মনে পড়ল, তখন যে বৈঠকগুলো হতো, বৈঠকে থাকতেন তোফায়েল আহমদ, আবদুল হামিদসহ অনেকে। আমি সেখানে যে কথাগুলো বলতাম, শুনে তারা বলতেন, আপনি এগুলো লেখেন না কেন? আমি বলতাম, নিজের লেখার ওপর আমার আস্থা নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে আমি লেখক নই। বলতে গেলে তারাই আমাকে জোর করে লেখকে পরিণত করলেন। দেশে ফিরে এসে আমি আমার লেখাগুলো আমার বন্ধু শামসুজ্জামান খানকে দেখাই। শামসুজ্জামান খান বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক। তিনি আমার লেখাগুলো নিয়ে মুক্তধারা প্রকাশনীকে দিলেন এবং চিত্তরঞ্জন সাহা আমার লেখা প্রকাশ করলেন। ৫০ বছর বয়সে সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা প্রকাশিত হওয়ার পর ৩০ বছর আমি অনেক লেখালেখি করেছি। কমবেশি পঠিতও হয়েছে। আমার সমগ্র লেখালেখিতে আমি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ভূমিকাকে মুখ্য করে তোলার পক্ষে ছিলাম। যে লক্ষ্য সামনে নিয়ে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা আরও কঠিন হয়ে ওঠে কিনা– আমি শঙ্কিত। 

সমকাল: আজকের পরিণতির পেছনে প্রধানত দায়ী কে বা কী?

যতীন সরকার: আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। স্বাধীনতার চেয়ে বড় কিছু নেই। কিন্তু এ কথা বলতেই হবে, আমাদের পুরোনো চার মূলনীতি আগেও সুষ্ঠুভাবে অর্জিত হয়নি। নতুন বাস্তবতায়ও কতখানি হবে, তা নিয়ে হয়তো ভাবনার অবকাশ আছে। তবে আজকের পরিণতির পেছনে প্রধানত দায়ী গণতন্ত্রহীনতা। গণতন্ত্রহীনতা কীভাবে ধাপে ধাপে আমাদের আজকের অবস্থানে নিয়ে এলো, তা সুচারুরূপে বিশ্লেষণ করা আজ আমার সাধ্যাতীত। 

সমকাল: যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আবহ সৃষ্টির কথা বলতেন, বিদ্যমান বাস্তবতায় আমরা কীভাবে, কোন পথে তা প্রয়োগ করতে পারি?

যতীন সরকার: শুরু থেকেই আমাদের শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকরা নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের জন্ম লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারিনি। চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। তবে আমি আশাবাদী মানুষ। এখনও বিশ্বাস করি, সামনের দিনগুলোয় পরবর্তী প্রজন্মকে লক্ষ্য করে আমরা যদি বাংলাদেশ যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে আবির্ভূত হয়েছিল, তা তুলে ধরতে পারি, তাহলে আমাদের অর্জিত বিজয় মর্যাদা পাবে। 

সমকাল: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাদের সময়ে দিলেন। 

যতীন সরকার: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

×