সাক্ষাৎকারে মামুনুর রশীদ
অর্জন থাকলেও মানবিক হতে পারিনি
শৃঙ্খলমুক্তির দিন, বিজয়ের দিন

মামুনুর রশীদ
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু সালেহ রনি
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৩ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৪:১৫
পৃথিবীর সব জায়গায় রাজনৈতিক মতানৈক্য আছে। কিন্তু আমাদের এখানে যেটা হয়েছে– এক দল থাকলে আরেক দল নাই। আবার আরেক দল থাকলে আগের দল নাই। এটি খুবই অগণতান্ত্রিক এবং সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা স্বাধীনতার ৫৩ বছরে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন আছে। তবে আমরা এখনও মানবিক হতে পারিনি। এটি আমাদের জাতিগত ব্যর্থতা। সংবিধানের মূল চেতনাই ছিল আমরা একটি মানবিক, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করব। এগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু সালেহ রনি
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপট কেমন ছিল?
মামুনুর রশীদ: ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের নানাভাবে নিপীড়ন করতে থাকে। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার ওপর প্রথম আঘাত আসে। গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকেও তৎকালীন সরকার নানাভাবে ব্যাহত করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানীসহ অনেক তরুণ নেতৃত্বের উদ্ভব হয়। ষাটের দশকে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেই নির্বাচনের আলোকে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে নানা যড়যন্ত্র শুরু করে। এর পর তো পাকিস্তান বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে এ দেশে।
সমকাল: স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট কেমন ছিল?
মামুনুর রশীদ: পাকিস্তান বাহিনীর সব যড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতাসহ আরও কিছু ছাত্রনেতার ভূমিকার কারণে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে থাকলেও তাঁর প্রতিচ্ছবি দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে। জাতির সব সংকট মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই নেতৃত্ব দিতে থাকেন তাজউদ্দীন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের প্রতীক হয়ে ওঠে তখন মেহেরপুরের মুজিবনগর। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে করা হয় প্রথম রাষ্ট্রপতি। তাঁর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বলতে গেলে ২৫ মার্চ বাঙালি জাতি মনোবল হারালেও এপ্রিলের ১০ তারিখ থেকে তা ফিরে পেতে থাকে এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে এগোতে থাকে।
সমকাল: আপনি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন?
মামুনুর রশীদ: ২৫ মার্চের রাতে ঢাকার গ্রিন রোডে প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক সামাদ সাহেবের বাসায় ছিলাম। এদিন রাতে ফার্মগেটে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙে যখন পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় ছড়িয়ে যায়, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব। দু’দিন আমরা কয়েকজন নানা ধরনের প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে ঘুরে ঘুরে টাঙ্গাইল এসে পৌঁছাই। সেখানে এসে কাদের সিদ্দিকীর (বঙ্গবীর) সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুদিন টাঙ্গাইলে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের নানা কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকি। কিন্তু আমি আগে থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলাম, সে জন্য পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সম্পৃক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এর পর মে মাসে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঢাকা থেকে ভারতের আগরতলায় যাই। সেখানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বাধীন বাংলা শিল্পী পরিষদের হয়ে মঞ্চনাটক, যাত্রা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড শুরু করি। তখন নাটক লিখেছি, প্রযোজনা করেছি, মঞ্চ নাটকও হয়েছিল, যার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ হয়। আমাদের এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি আপামর বাঙালি স্বাধীনতার স্বপ্নকে লালন করতে শুরু করেন।
সমকাল: কখন নিশ্চিত হলেন পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে? তখনকার সামরিক পরিকল্পনা কী ছিল?
মামুনুর রশীদ: ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে– এটি ভাবিনি। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তখন অবশ্য একটু একটু স্বপ্ন মনে উঁকি দিতে থাকে। সেদিন কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে প্রায় ৪০ গজ দূরে জহির রায়হানের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাকে দেখে ছুটে আসেন, আমিও ছুটে যাই। আমরা আলিঙ্গন করি। বিজয়ের আনন্দের এ উষ্ণতা আজও ভুলিনি।
সমকাল: যে লক্ষ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তার কতটা পূরণ হয়েছে?
মামুনুর রশীদ: অনেক কথাই বলা যায়, তবে লাল-সবুজের বাংলাদেশের বড় অর্জন, বহির্বিশ্বে আমাদের নিজস্ব পরিচয় হয়েছে। কখনও চিন্তা করিনি বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের পরিচয়ে আমরা নাটক করব, সিনেমা করব। এখন তাই হচ্ছে। রেমিট্যান্স আসছে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন থাকলেও আমরা এখনও মানবিক হতে পারিনি। এটি আমাদের জাতিগত ব্যর্থতা।
সমকাল: এবারের বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
মামুনুর রশীদ: এবার বিজয়ের আনন্দ অনেকটাই ম্লান। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যখন জানলাম বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিজয়ের সেই আনন্দের মধ্যেও তখন শহীদদের স্মরণে মন ব্যথিত হয়েছিল। এবারও বিজয়ের আনন্দের মধ্যে সেরকম বেদনা অনুভব হচ্ছে। আমি আশা করব, আমরা সবাই মিলে স্বাধীনতার যে অপশক্তি এবং স্বাধীনতার যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের আমরা ভুলে যাব না।
সমকাল: রাজনৈতিক নেতৃত্বে বিভাজন কেন? এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
মামুনুর রশীদ: পৃথিবীর সব জায়গায় রাজনৈতিক মতানৈক্য আছে। কিন্তু আমাদের এখানে যেটা হয়েছে– এক দল থাকলে আরেক দল নাই, আবার অরেক দল থাকলে আগের দল নাই। এটি খুবই অগণতান্ত্রিক এবং সামন্ততান্ত্রি মানসিকতা। বিভিন্ন দল আছে, তাদের আলাদা মেনিফেস্টো থাকবে; কিন্তু আমি থাকলে তুমি নাই– এমনটা অত্যন্ত বাজে নজির এবং গণতন্ত্রের জন্য অভিশাপ। এসব কারণে আমাদের সংসদকে কোনোভাবে কার্যকর করা যাচ্ছে না।
সমকাল: জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, সংবিধান নিয়ে সাম্প্রতিক যেসব আলোচনা হচ্ছে– এ বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই।
মামুনুর রশীদ: অবান্তর সব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এটি কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক করা ঠিক নয়। জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। আর সংবিধান নিয়ে যেসব প্রশ্ন আছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। পৃথিবীর সব দেশে সংবিধান সংশোধন-সংযোজন হয়। মৌলিক বিষয়গুলো ঠিক রেখে আমাদের সংবিধানেও সংশোধন-সংযোজন হতে পারে। তবে সেটি নিয়ম অনুযায়ী হতে হবে।
সমকাল: স্বাধীন দেশের কাছে কী প্রত্যাশা করেন।
মামনুর রশীদ: বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চেতনাই ছিল আমরা একটি মানবিক, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করব। এগুলোই বাস্তবায়ন হোক।
সমকাল: তরুণ প্রজন্মের কাছে আপনার প্রত্যাশা?
মামুনুর রশীদ: তরুণদের অবশ্যই ইতিহাস চর্চা করতে হবে। ইতিহাসের সত্য থেকে তাদের শিক্ষা নিতে হবে। ইদানীং দেশে ভিন্ন সংস্কৃতির কাওয়ালি থেকে নানা কর্মকাণ্ডের প্রচলন দেখা যাচ্ছে। তরুণদের এসব সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতি বিকাশে তাদের ভূমিকা না থাকলে আমরা জাতি হিসেবে গভীর সংকটে পড়ব।
সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।
মামুনুর রশীদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।
- বিষয় :
- বিজয়ের মাস
- মামুনুর রশীদ