সাক্ষাৎকারে নাজমা শাহীন
জীবদ্দশায় এমন দিন দেখব, ভাবিনি

নাজমা শাহীন
সাজিদা ইসলাম পারুল
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৫ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৪:১৮
গণতন্ত্র কখনও থাকতে পারে, আবার নাও পারে। কিন্তু চব্বিশের আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ এক নয় বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমা শাহীন বলেছেন, চব্বিশের আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ এক নয়। ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানের ঔপনিবেশিকতা থেকে স্বাধীন হয়েছি। তিনি মনে করেন, একটি দেশের সরকার ফ্যাসিস্ট হতে পারে। গণতন্ত্র থাকতে পারে; আবার নাও পারে। কিন্তু স্বাধীনতা ভার্সন-টু, এটা কী করে হয়? মুক্তিযুদ্ধকে এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে বর্তমান প্রজন্ম এবং জীবদ্দশায় তা দেখতে হবে– কখনও ভাবিনি। সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বর্তমান অবস্থা নিয়ে মর্মাহত বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে নাজমা জানান, শৈশবে ‘প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার’, ‘মাস্টার দা সূর্য সেন’, ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ জাতীয় বই পড়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছেন। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠায় কাজটি সহজ হয়েছে। বাবার চাকরি সূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে বসবাস। আজিমপুর গার্লস স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী নাজমা মা মেহেরুন্নেসা শিকদারের মুখ থেকে বাবার ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত গল্প শুনতেন। আর চাচা তৎকালীন ছাত্রলীগের সহসভাপতি মার্শাল মনিরুল ইসলামের কাছ থেকে বিপ্লবী প্রীতিলতা, মাস্টার দা সূর্য সেনের গল্প শুনে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
নাজমা শাহীন বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন দমনে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেন, এ ধারা ভঙ্গ করার জন্য ১০ জন ১০ জন করে শিক্ষার্থী রাস্তায় নামবেন। প্রথম ১০ জনের মধ্যে ছিলেন আমার বাবা ভাষাসৈনিক আবু জায়েদ শিকদার। বাবাসহ সবাইকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও কেউ জানতেন না। পরের ১০ জনের মধ্যে বরকত পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। শ্যামলা ও লম্বা গড়নের বরকত সাদা শার্ট, খাকি রঙের প্যান্ট পরেছিলেন। বাবার একই ধরনের পোশাক থাকায় সবাই ভেবেছে বাবা মারা গেছেন। দাদির শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হলে নানা ঢাকায় আসেন বাবার সন্ধানে। পরে জেল থেকে বাবার পাঠানো চিরকুটের মাধ্যমে সবাই তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার কথা জানতে পারেন। ৩৯ দিন পর মুক্তি পান তিনি।
তিনি বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে যাই। পরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে থাকি। ১৯৭০ সালে ঢাকার স্কুলগুলোয় কমিটি হলো। আজিমপুর গার্লস স্কুলে ছাত্রলীগের সভাপতি হলেন ডলি জহুর; সাধারণ সম্পাদক করা হলো আমার বড় বোন লুৎফা হোসেন রোজীকে। আমার স্বামীও সে সময় ছাত্রলীগের নির্বাহী কমিটিতে ছিলেন। ওই বছর স্কুলের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশ নেয়। কারণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ‘পাকিস্তানের দেশকৃষ্টি’ বই পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে স্কুলে স্কুলে গড়ে ওঠা আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন আমার বোন রোজী ও জাসদ নেতা ডা. মোস্তাক হোসেন। সে সময় প্রতিটি আন্দোলনে মেয়েদের থাকতে হতো। ওই আন্দোলন সফল হয়। এর পর ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বড় অর্জন। সে নির্বাচনে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পোলিং এজেন্ট ছিলাম।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পরই মেয়েরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ‘প্রশিক্ষণ’ নেওয়া শুরু করে বলে জানান নাজমা শাহীন। তিনি বলেন, ছাত্রলীগের আয়োজনে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ভেতরে ডামি রাইফেল দিয়ে দুদু ও পিয়ার ভাই প্রশিক্ষণ দিতেন। শত্রুকে প্রতিহত করার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ আমরা সেখানেই পেয়েছি। এর পর তো দুই বোন একসঙ্গে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ২৫ মার্চের পর থেকে ধরলে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য যেসব সংগঠন কাজ করছিল, আমরা তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ফলে আগে থেকেই একটি আদর্শিক জায়গায় আমরা ছিলাম যে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। ২৫ মার্চ রাত থেকে ২৬ ও ২৭ তারিখ সকাল পর্যন্ত যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল, আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
নাজমা শাহীন অস্ত্র চালানো, গ্রেনেড ছোড়া, এলএমজি, এসএমজি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সাদিপুর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা খসরুর নেতৃত্বে দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ। এর পর ভারতের আগরতলায়ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা দলের সঙ্গে চলে আসেন বালিয়াপাড়ার বেইজ ক্যাম্পে। অবরুদ্ধ ঢাকায় চালান গেরিলা অভিযান। প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা বর্ণনায় নাজমা শাহীন বলেন, শুরুতে আমরা ছোট ছোট অপারেশনে যোগ দিয়েছিলাম। আমার বোন গোপীবাগে একটি অপারেশনে যোগ দেন। সেখানে শান্তি কমিটির এক চেয়ারম্যান আর্মির কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিতেন। এলাকার মেয়েদের ধরে পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্পে পাচার করতেন। তাকে ধরে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। আনার পর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেয়নেট চার্জ করে তাকে মেরে ফেলার দায়িত্ব পান আমার বোন। এগুলোও ছিল প্রশিক্ষণের অংশ। ৬ ডিসেম্বর ডেমরা মুক্ত হওয়ার কথা এখনও ভোলেননি তিনি।
বহু ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে উল্লেখ করে নাজমা শাহীন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম, আজ দেশের এ অবস্থা দেখে খুবই মর্মাহত। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জীবদ্দশায় এমন দিন দেখতে হবে; মুক্তিযুদ্ধকে এমনভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে এই প্রজন্ম, কখনও ভাবিনি।’ তিনি বলেন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন, এরপর ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ– আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধারণ করেছি। বাবা ভাষা আন্দোলন করেছেন। আমরা ’৬৯-এর গণআন্দোলনে যোগ দিয়েছি। একই চেতনায় একত্রিত হয়েছি। এরই ফলশ্রুতিতে ’৭১-এ স্বাধীন দেশ করার জন্য যুদ্ধ করেছি। এটি কিন্তু একটি ধারাবাহিকতা এবং সেভাবেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
নাজমা শাহীন বলেন, ‘এখন যেটা বলা হচ্ছে, স্বাধীনতা ভার্সন টু। এটি কী করে হয়? আমরা পাকিস্তানের ঔপনিবেশিকতা থেকে দেশকে স্বাধীন করেছি। একটি দেশের সরকার ফ্যাসিস্ট হতে পারে। গণতন্ত্র কখনও থাকতে পারে; আবার নাও পারে। কিন্তু চব্বিশের আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ তো এক নয়। একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধের যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, সেটা তো একদিনে শুরু হয়নি। ’৪৭ থেকে শুরু হয়ে সফল হতে ’৭১ পর্যন্ত লেগেছে। তার সঙ্গে এ কয়দিনের (৩৯ দিন) আন্দোলন, যেটি সরকার পতনের আন্দোলনকে মেলানো হচ্ছে। এটি নিয়ে কেউ কথা বলছে না। এটিই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের কাছে সবচেয়ে কষ্টের।’
- বিষয় :
- বিজয়ের মাস