ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকারে ফাহাদ

ফেডারেশন আমার জন্য কিছু করেনি

ফেডারেশন আমার জন্য কিছু করেনি

ছবি- সংগৃহীত

সাখাওয়াত হোসেন জয়

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৪ | ০৯:৫৯ | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৪ | ১২:৪৬

২০০৮ সালে শখের বসে দাবা খেলা। ঘুঁটির চালে এতটাই মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন, তিন বছর পর পেশা হিসেবে দাবাকেই বেছে নেন ফাহাদ রহমান। ২০১৯ সালের মার্চে পান আন্তর্জাতিক মাস্টার (আইএম) খেতাব। ছোটবেলা থেকে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখা ফরিদপুরের মধুখালী থেকে উঠে আসা এ দাবাড়ু বারবার স্নায়ুর লড়াইয়ে হেরে যান। অবশেষে ভিয়েতনামে গ্র্যান্ডমাস্টার টুর্নামেন্টে রানারআপ হয়ে প্রথম নর্ম পান ফাহাদ। আর দুটি নর্ম পেলে দেশের ইতিহাসে হয়ে যাবেন ষষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার। দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর সাফল্য, নানা চ্যালেঞ্জ এবং দাবা ফেডারেশন থেকে সহযোগিতা না পাওয়ার ক্ষোভসহ আরও অনেক বিষয়ে ভিয়েতনাম থেকে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন ফাহাদ রহমান। শুনেছেন সাখাওয়াত হোসেন জয়

সমকাল : নর্ম পাওয়ার জন্য অভিনন্দন। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পথে এগোলেন একধাপ…
ফাহাদ :
অনেক ভালো লাগছে। অনেক চেষ্টার পর হলো। এর আগে অনেকবার খুব কাছে গিয়েও হয়নি। এবার হয়েছে।

সমকাল : অনেক দিন অপেক্ষা করতে হলো নর্ম পেতে। এতদিন কেন লাগল?
ফাহাদ :
প্রথমত গ্র্যান্ডমাস্টার টাইটেলটা অনেক কঠিন। নর্ম করার জন্য যে কন্ডিশন, সেটা পূরণ করা অনেক কঠিন। জিএমদের সঙ্গে অনেক হাইস্কোরে জিততে হবে। ৯ খেলার ৭টায় জিততে হবে। দ্বিতীয়ত ১০ বছর আগের চেয়ে এখন প্রতিযোগিতা একটু কঠিন। সেই অনুযায়ী প্রতিযোগিতা এখন উন্মুক্ত হয়ে গেছে। অনেক লাইন থিউরি মুখস্ত করতে হয়, হাজার হাজার চাল মনে রাখতে হয়। বিদেশে অন্য প্লেয়াররা যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, বাংলাদেশের প্লেয়াররা তো সেটা পাচ্ছে না। যেমন কোচের সুবিধা দেশে নেই। দাবার অনেক ম্যাটেরিয়ালস আছে, যেমন ট্রেনিংয়ে অনেক ম্যাথড আছে, যেগুলো বাংলাদেশে পর্যাপ্ত নেই। সব মিলিয়ে এর জন্য আমার নর্ম পেতে অনেক সময় লাগছে।

সমকাল : একটা নর্ম পেতে চ্যালেঞ্জটা কোথায় কোথায় ছিল?
ফাহাদ :
নর্মটা আমি আরও এক বছর আগে পেতে পারতাম। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকতার কারণে আমি অনেক নর্ম মিস করেছি। শুধু শেষ রাউন্ডে জিতলেই হতো। আমি মানসিক চাপ বা টেনশনের কারণে অনেকবার শেষ রাউন্ডগুলো জিততে পারিনি। তবে এবার শেষ রাউন্ড জেতার দরকার ছিল, ঠিকই জিতেছি।

সমকাল : এই নর্মের জন্য দাবা ফেডারেশন নাকি আপনার জন্য দেশে টুর্নামেন্টে করেছে এবং বিদেশে খেলতে পাঠিয়েছে?
ফাহাদ :
এটা মোটেও ঠিক না। প্রথমত দেশে ফেডারেশন থেকে যে টুর্নামেন্ট করেছে, সেটা ছিল ২০২১ সালে। আর ২০২৪ সালে যে টুর্নামেন্ট, সেটা নিয়াজ স্যারের (নিয়াজ মোর্শেদ) উদ্যোগেই হয়েছে। এই টুর্নামেন্ট আমার জন্য ছিল না, এটা বাংলাদেশের সবার জন্য ছিল। আমি শুধু বাংলাদেশি একজন হয়ে প্রতিযোগিতায় খেলেছি।

সমকাল : গ্র্যান্ডমাস্টার হতে আপনার আর কতদিন লাগতে পারে?
ফাহাদ :
একটা হয়েছে, আর দুটো নর্ম পেলেই আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হবো। রেটিং লাগে ২৫০০। আমার রেটিং এখন ২৪৩১। পরিকল্পনা আছে এ বছরের মধ্যে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার চেষ্টা করব।

সমকাল : স্পন্সর নিয়ে আপনার একটা হাহাকার ছিল। দাবায় কেন আসছে না পৃষ্ঠপোষকরা?
ফাহাদ :
আপনি তো জানেন, আমাদের দেশে সব স্পোর্টসের কী খারাপ অবস্থা। কোনো স্পন্সর নেই। ট্যালেন্টের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। শুধু দাবাই যে এই সমস্যা, তা কিন্তু নয়; অন্যান্য স্পোর্টসেও একই চিত্র। আপাতত আমার কোনো দীর্ঘমেয়াদি পৃষ্ঠপোষকতা নেই। এই টুর্নামেন্টে আমাকে বাংলাদেশ পুলিশ থেকে পাঠিয়েছে। গত এক বছরে আমি নিজের টাকায় বিদেশে পাঁচ-ছয়টি টুর্নামেন্ট খেলেছি। স্পন্সর নেই কেন, আমি জানি না। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার ট্র্যাকে বাংলাদেশে আমি একাই আছি। আমি যেহেতু একটা নর্ম পেয়েছি, যদি আরেকটু সুযোগ-সুবিধা পেতাম, তাহলে জিএমের রাস্তাটা আরেকটু সহজ হতো।

সমকাল : কী ধরনের সহযোগিতা?
ফাহাদ :
সহযোগিতা বলতে বিদেশে যে টুর্নামেন্টগুলো হয়, সেগুলো খেলতে আমার নিজের পকেট থেকে অর্থ খরচ করতে যেন না হয়। যাতে স্পন্সরের সহযোগিতায় এই টুর্নামেন্টগুলো খেলতে পারি। এখন টুর্নামেন্ট খেলেই গ্র্যান্ডমাস্টার হতে হবে।

সমকাল : এ ক্ষেত্রে দাবা ফেডারেশন আপনার জন্য কী করতে পারে বা তাদের করণীয় কী?
ফাহাদ :
আমি আইএম হওয়ার পর আমাকে কোনো সাপোর্ট করেনি ফেডারেশন। আমাকে হয়তো একটা বা দুটো টুর্নামেন্ট খেলিয়েছে, সেটাও আমি মনে করতে পারছি না। আমার মনেও পড়ছে না ফেডারেশন কোনোদিন খেলাইছে কিনা। আমি যেমন পাই না, অন্য কোনো প্লেয়ার ফেডারেশন থেকে সাপোর্ট পায় কিনা, আমার মনে হয় না। আমি জানি না, ফেডারেশন থেকে কেন এত গাফিলতি। ২০২১, ২০২২ সালে ফেডারেশনের ফান্ডে অনেক টাকা ছিল। আমার পেছনে কোনো খরচই করা হয়নি। দেশে কিছু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট করছে, যেটার কোনো গুরুত্ব নেই। গ্র্যান্ডমাস্টাররাও বলেন, এত টাকা খরচ করে এসব টুর্নামেন্ট করার কোনো মানে নেই। শুধু সুনাম নেওয়া এবং নিউজ পাওয়ার জন্য এসব টুর্নামেন্ট করে। আর আপনি যে বলেছেন আমার জন্য টুর্নামেন্ট করেছে, এগুলো কিন্তু আমার জন্য করে নাই। এটা দেশের জন্য করেছে। ফেডারেশন আমার জন্য তেমন কিছু করেনি।

সমকাল : নর্ম পাওয়ার পর ফেডারেশন থেকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে কিনা?
ফাহাদ :
আমি তো বাইরে আছি। এখানে আমাকে কেউ অভিনন্দন করেনি, বাসায় করেছে কিনা, তা আমি জানি না। আমাকে ফেডারেশন থেকে সরাসরি অভিনন্দন পর্যন্ত জানায়নি।

সমকাল : ফেডারেশনের কর্তাদের সঙ্গে কোনো দূরত্ব রয়েছে, নাকি আপনার সাফল্যটা ভালোভাবে নিতে পারেনি?
ফাহাদ :
আমি যতটুকু জানি, আমার সঙ্গে কোনো বিষয়ে দূরত্ব হয়নি। কেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, এটা আমি বলতে পারব না। আমাদের জন্য এটাই বাস্তবতা। ফেডারেশনের বলতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শোয়েব রিয়াজ আলম স্যার (যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) বেশ সাপোর্ট করেন। তবে তিনি ফেডারেশনের পক্ষ থেকে নন, তাঁর পুলিশ ক্লাবের পক্ষ থেকে সাপোর্ট করেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। ২০২৩ সালে বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্ট খেলিয়েছেন। আর এ বছর এই টুর্নামেন্ট খেলিয়েছেন।

সমকাল : ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে সহযোগিতা পান কিনা? তাঁর স্ত্রীও তো ফেডারেশনে আছেন…
ফাহাদ :
আপনি ঠিক ধরেছেন (পরিবারতন্ত্র)। তবে আমি ওই সব বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আমি পলিটিকসে যেতে চাই না। আমি জানি না, কেন তারা এমন। প্লেয়ারদের প্রতি, আমার প্রতি গাফিলতি তাদের। প্লেয়ারদের পেছনে অর্থ সেভাবে খরচ হচ্ছে না, তাহলে ফেডারেশনের টাকাগুলো কোথায় যায়? ফেডারেশনে কী হচ্ছে, তা আমি জানি না।

সমকাল : এই পর্যায়ে আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আপনাকে। দাবায় যারা আসতে চান, সেই নতুন প্রজন্মের কাছে আপনার মেসেজটা কী?
ফাহাদ :
প্লেয়ারদের জন্য আমার মতামত হলো, কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। বাংলাদেশে দাবা খেলা শেখাটা অনেক কঠিন। কারণ বাংলাদেশে অনেক কিছুরই অভাব। কেউ গ্র্যান্ডমাস্টার হতে চাইলে তার মনোবল অনেক শক্ত হতে হবে। অনেক বাধা আসবে, সেটাকে এড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আর যদি কর্মকর্তাদের জন্য কিছু বলতে হয়, আমি বলব প্লেয়ারদের যেন আরও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। একটা জাতীয় কোচের প্রয়োজন। আপনি দেখেন, প্রতিটি ইভেন্টেই কিন্তু জাতীয় কোচ আছে। ক্রিকেট, ফুটবলে আছে; কিন্তু দাবাতে নেই। আমি বলব, একজন জাতীয় কোচ আসতে হবে, যাতে করে পরবর্তী প্রজন্ম কোচের মাধ্যমে নিজেদের খেলায় উন্নতি করতে পারে। কোচের সহযোগিতা ছাড়া নিজে নিজে তো আর দাবা শেখা যায় না। সবাই একা একা শিখতে পারে না, যেমন আমি শিখছি।

সমকাল : অনেক দেশে ঘুরেছেন। বড় বড় দাবাড়ুদের সঙ্গে খেলেছেন। অন্যান্য দেশের চেয়ে আমরা কোথায় পিছিয়ে?
ফাহাদ :
যাদের সঙ্গে আমি মিশেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে আমাদের মেন্টালিটি সম্পূর্ণ আলাদা। দাবায় ওদের তুলনায় আমাদের স্বপ্ন অনেক ছোট। দাবায় লক্ষ্য বড় থাকতে হবে। শুধু গ্র্যান্ডমাস্টারই শেষ না, এর পরও অনেক লেভেল আছে। সেই লেভেলে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগোতে হবে। ওদের অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। তারা অনেক বেশি টুর্নামেন্ট খেলতে পারে। নিজেদের দেশে তাদের অনেক টুর্নামেন্ট হয়, কোচও আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

সমকাল : পার্থক্যটা কমানোর জন্য করণীয় কী?
ফাহাদ :
প্রথমত আপনাকে একজন মডেল প্লেয়ার বানাতে হবে। ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান মডেল খেলোয়াড়। দাবায় রোল প্লেয়ার বানাতে হবে, যাতে তাঁকে দেখে আরও অনেকে অনুপ্রাণিত হয়। গ্রামগঞ্জে, সব জায়গায় ক্রিকেট খেলে শুধু সাকিবের মতো রোল মডেল আছেন বলে। এই খেলার পরিচিতি বাড়াতে হবে। এর পর বিদেশিদের সঙ্গে মিল রেখে যতটুকু সম্ভব, টুর্নামেন্ট করা। পাশের দেশ ভারতকে চাইলে অনুসরণ করা যায়। তাদের দেশে ৯০ জনের মতো গ্র্যান্ডমাস্টার আছেন। তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক আইডিয়া নিতে পারি। ভারত যদি পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?

সমকাল : ভারতে ৯০ জন গ্র্যান্ডমাস্টার অথচ উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার বাংলাদেশের। এর পরও বাংলাদেশের গ্র্যান্ডমাস্টার মাত্র পাঁচজন…
ফাহাদ :
বিশ্বনাথন আনন্দকে তো সবাই চিনেন। তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ভারতের অন্যতম সেরা একজন খেলোয়াড়। আনন্দ না থাকলে ভারতে কিন্তু এত গ্র্যান্ডমাস্টার হতো না। আনন্দ কিন্তু রোল মডেল হতে পারছেন। বাংলাদেশে দাবায় রোল মডেল নেই। কাকে অনুসরণ করবে। পর্তুগাল এত ফুটবল খেলে রোনালদোর জন্য। মেসি-ম্যারাডোনার জন্য আর্জেন্টাইনরা ফুটবল খেলে। দাবাতে আনন্দের মতো রোল মডেল হয়েছে ভারতে, যে কারণে তাদের এত গ্র্যান্ডমাস্টার। বাংলাদেশেও আশা করি ভবিষ্যতে আরও অনেক জিএম আসবে।

সমকাল : দাবার রোল মডেল তো ফাহাদই হচ্ছেন?
ফাহাদ :
(হাসি…) আমি চেষ্টা করব।  আগের তুলনায় এখন অনেক প্লেয়ার আমি ফেডারেশনে দেখি, এটা একটা ভালো দিক। ভবিষ্যতে আরও ভালো পারফরম্যান্স করতে পারি এবং দেশের রোল মডেল হতে পারি এই চেষ্টা করব।

সমকাল : দাবায় এমন কোনো চাল দিয়েছেন, যেটা আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল…
ফাহাদ
: এ রকম অনেক আছে। ২০২৩ সালে উজবেকিস্তানে প্রেসিডেন্স কাপে একজন হাই রেটিংয়ের গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে আমি একটা ভালো চাল দিয়ে পয়েন্ট নিয়েছিলাম। সেই ম্যাচটি আমি জিতেছিলাম। ভিয়েতনামে এই টুর্নামেন্টে শেষ ম্যাচটি আমি যেভাবে জিতেছি, জিএম নর্মের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সমকাল : দেশের পতাকা নিয়ে সামনে কী চ্যালেঞ্জ আছে?
ফাহাদ :
আমার প্রথম টার্গেট এই বছরের মধ্যে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া। তার পর নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোব। বাংলাদেশি প্লেয়ারদের মধ্যে যেন সর্বোচ্চ লেভেলে যেতে পারি, সেই চেষ্টা করব। বাংলাদেশে কেউ ২৬০০ রেটিং টাচ করতে পারেনি। এটা টাচ করার চেষ্টা করব। যদি ২৬০০ টাচ করতে পারি, তাহলে আরও বড় লেভেলে যাওয়ার চেষ্টা করব।

আরও পড়ুন

×