ফিরে দেখা ২০২৪
প্রজন্মের পালা বদল

ফাইল ছবি
সেকান্দার আলী
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১০:২৭
টি২০ বিশ্বকাপের বছর ছিল ২০২৪। মার্কিন মুলুকে বিশ্বকাপের অভিষেক এবং বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। সুপার এইটের ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে হেরে সেমিফাইনাল খেলতে না পারা দর্শকদের হতাশ করলেও খুশি ছিল বিসিবি। ২০ দলের টি২০ বিশ্বকাপে তিন জয়কেই সেরা সাফল্য গণ্য করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন বিসিবির সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। বিদায়ী বছরটি দেশের ক্রিকেটে নানা দিক থেকেই ছিল বৈচিত্র্যময়। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে দেশের ক্রিকেট প্রশাসনে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) কোটায় সভাপতি হন ফারুক আহমেদ। প্রথমবারের মতো একজন ক্রিকেটার হলেন বোর্ড সভাপতি। দেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি বিন মুর্তজার খেলতে না পারা। রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানকে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ করা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের টি২০তে ক্লিন সুইপ বছরান্তে এসব প্রাপ্তি তুলে ধরেছেন সেকান্দার আলী।
হতাশার বিদায় সাকিবের: বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান জাতীয় দলে নেই– ভাবতেই কেমন লাগে। সক্ষমতা ও খেলার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সাকিব জাতীয় দলে নেই রাজনৈতিক কারণে। তিনি নিরাপত্তার কারণে দেশে ফিরতে পারছেন না। মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসানকে ছাড়াই গতকাল মাঠে গড়িয়েছে একাদশ বিপিএল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পরই সাকিব বুঝে গিয়েছেন তিন সংস্করণে খেলার মতো মানসিকতা হারিয়েছেন। সেপ্টেম্বরে ভারতে টেস্ট খেলার সময় হঠাৎ করেই টেস্ট ও টি২০ ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। কানপুরে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিশ্বকাপেই টি২০-এর শেষ ম্যাচ খেলেছেন। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষ ম্যাচ খেলে টেস্ট থেকে অবসর নিতে চান। সাকিবকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানাতে বিসিবি উদ্যোগ নিলেও শেষমুহূর্তে পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়। খেলা দূরের কথা, দেশে ফেরারই অনুমতি পাননি বাঁহাতি অলরাউন্ডার। জাতীয় দলেও খেলতে দেওয়া হচ্ছে না তাঁকে। সেদিক থেকে দেখলে সাকিবের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ বলা যায়।
দেশে খেলতে না পারলেও বিদেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সাকিব। আবুধাবি টি১০ ও লঙ্কান টি১০ খেলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের লিগেও ছিলেন তিনি। দেশের হয়ে খেলতে না পারার হতাশা নিমজ্জিত সাকিবের জন্য দুঃসংবাদ দেয় ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড। বোলিং অ্যাকশনে ত্রুটি ধরা পড়ায় বোলিং নিষিদ্ধ হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটসহ বিদেশের সব লিগে। যদিও নতুন করে বোলিং অ্যাকশন পরীক্ষা দিয়েছেন ভারতের চেন্নাইয়ে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাকিব তবু বিদেশে আছেন, মাশরাফি বিন মুর্তজার সে সুযোগও নেই। নিরাপত্তার কারণে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামমুখোও হতে পারেন না নড়াইল এক্সপ্রেস। সাকিবের মতো মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও আন্তর্জাতিক টি২০ থেকে অবসরের ঘোষণা দেন ভারতে।
টি২০ বিশ্বকাপ ছিল মিশ্র অনুভূতির: এ বছর যুক্তরাষ্ট্র-ওয়েস্ট ইন্ডিজ যৌথভাবে আয়োজন করেছিল টি২০ বিশ্বকাপ। ডালাসে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করে বাংলাদেশ। নিউইয়র্কে জিততে জিততে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হারলেও সেন্ট ভিনসেন্টের অ্যারোন ভ্যালেতে নেদারল্যান্ডস ও নেপালকে হারিয়ে সুপার এইটে খেলা নিশ্চিত করে। যদিও দ্বিতীয় রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও আফগানিস্তানের কাছে হেরে টুর্নামেন্ট শেষ করে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সাকিব ছিলেন সফল। ৪৬ বলে ৬৪ রান দিয়ে জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। টি২০ বিশ্বকাপে পেসার তানজিম হাসান সাকিব ও লেগস্পিনার রিশাদ হোসেন নজরকাড়া পারফরম্যান্স করেন। জয়ের দিক দিয়ে সেরা বিশ্বকাপ গেছে বাংলাদেশের। কারণ আগের ৮ বিশ্বকাপে সেরা সাফল্য ছিল দুই জয়। ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নেদারল্যান্ডস ও জিম্বাবুয়েকে হারিয়েছিলেন সাকিবরা।
টেস্টে ম্যাজিক পারফরম্যান্স: বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা ফল ছিল এবার। গত বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় দিয়ে নতুন সাইকেল শুরু করেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ২০২৪ সাল শুরু করেন টেস্ট জয় দিয়ে। টেস্ট ক্রিকেটে দেশের সবচেয়ে চমক ছিল পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করা। বাংলাদেশ অলরাউন্ড ক্রিকেট খেলে ইতিহাস গড়েছে। পিছিয়ে পড়েও টেস্ট জয়ের কৃতিত্ব দেখান শান্তরা। প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে সাদমান ইসলামের ৯৩, মুমিনুল হকের ৫০, মুশফিকুর রহিমের ১৯১, লিটন দাসের ৫৬ ও মেহেদী হাসান মিরাজ ৭৭ রান করেন। প্রথম ইনিংসে লিড পাওয়ায় বোলাররা উজ্জীবিত ছিলেন। সাকিব তিন, মিরাজ চার উইকেট নিলে ১৪৬ রানে অলআউট হয় পাকিস্তান। ১০ উইকেটে ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। মিরাজ হন ম্যাচসেরা। সিরিজ নির্ধারণী দ্বিতীয় টেস্টে লিটন দাসের সেঞ্চুরি (১৩৮) ও মিরাজের হাফ সেঞ্চুরি আর হাসান মাহমুদের পাঁচ ও নাহিদ রানার চার উইকেটে দ্বিতীয় টেস্টও জিতে নেয় বাংলাদেশ। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শেষ সিরিজের শেষ ম্যাচটি জিতেছেন মিরাজরা। জাকের আলী, নাহিদ রানা, তাইজুল ইসলাম জাদুতে ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ।
উইন্ডিজে টি২০ বাজিমাত: ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজ জিততে পারলেও টি২০ হেরেছিল বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর রেকর্ড ছিল না। যদিও ২০১৮ সালে নিরপেক্ষ ভেন্যু ফ্লোরিডায় টানা দুই ম্যাচ জিতেছিলেন সাকিবরা। স্বাগতিক হিসেবে উইন্ডিজ হোম সিরিজ হেরেছিল। এবার নিজেদের মাটিতে ২০ ওভারের ক্রিকেট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। লিটন কুমার দাসের দল অলআউট ক্রিকেট খেলেছে সিরিজজুড়ে। অফস্পিনার শেখ মেহেদি সিরিজজুড়েই ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন।
হাথুরুর অনাকাঙ্ক্ষিত বিদায়: চন্ডিকা হাথুরুসিংহের আচরণ নিয়ে আপত্তি ছিল বিসিবি কর্মকর্তাদের। ক্রিকেটারদের মধ্যেও অসন্তোষ ছিল। ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। নাজমুল হাসান পাপনের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় হাথুরুসিংহে সেবার ছাড়া পেলেও শেষরক্ষা হয়নি। ফারুক আহমেদ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই হাথুরুকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। পাকিস্তানে টেস্ট সিরিজ জেতায় সেটা সম্ভব না হলেও ভারত সফরের পর হাথুরুসিংহেকে বিদায় বলে দেয় বিসিবি। ফিল সিমন্সকে করা হয় নতুন হেড কোচ। মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে সিনিয়র সহকারী কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রশংসিত হন ফারুক। সালাউদ্দিনের অন্তর্ভুক্তিতে ব্যাটিং কোচ ডেভিড হেম্পকেও বাদ দেওয়া হয় জাতীয় দল থেকে।
যুব এশিয়া কাপের শিরোপা ধরে রাখা: বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দল এশিয়া কাপে ভালো খেলা শুরু করেছে ২০২৩ সাল থেকে। এই টুর্নামেন্টে গত বছর প্রথমবারের মতো শিরোপ জেতে বাংলাদেশ। এ বছর ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন আজিজুল হাকিম তামিমরা। দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। পেসার ইকবাল হোসেন ইমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন। এশিয়া কাপের সাফল্য নতুন করে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন বুনছে ক্রিকেটারদের মধ্যে।
অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপে আলো ছড়ান মেয়েরা: নারী যুব এশিয়া কাপে বাংলাদেশ প্রথম থেকেই ভালো ক্রিকেট খেলেছে। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করে। মালয়েশিয়াকে হারিয়ে ‘এ’ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সুপার ফোরে নেপালকে হারিয়ে ফাইনালে উন্নীত হয়। যদিও শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ভারতের কাছে হেরে গেছেন মেয়েরা। ছোটদের ক্রিকেটে সাফল্য পেলেও বড়রা টি২০ বিশ্বকাপে ভালো করতে পারেনি। নিরাপত্তার কারণে নারী বিশ্বকাপের ভেন্যু ঢাকা থেকে সরে গেছে দুবাইয়ে।
প্রথম ক্রিকেটার সভাপতি: রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাব দেশের ক্রীড়াঙ্গনেও পড়েছে। বিসিবিতে সরকারি হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য হওয়ায় গঠনতান্ত্রিক নিয়মে ফারুক আহমেদ ও নাজমুল আবেদীন ফাহিমকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। লবিংয়ে এগিয়ে থাকায় জরুরি সভার পরিচালকদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হন ফারুক। দেশের ক্রিকেট প্রথমবারের মতো একজন খেলোয়াড়কে সভাপতি হিসেবে পায়। বিসিবি সভাপতি হওয়ার পরই দেশের ক্রিকেটকে ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি দেন নতুন সভাপতি। অবকাঠামোগত উন্নয়নে ফোকাস দেওয়ার কথা জানান তিনি। যদিও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উন্নতি চোখে পড়েনি। ঢাকা বা বিভাগীয় শহরের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে একাডেমি গড়ে তোলার কথা বললেও তা আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমান সভাপতি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না করে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন। বোর্ড সভাপতি হয়েও বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান তিনি।