ক্রিকেটবিশ্বে দেশকে লজ্জায় ফেলেছে বিপিএল

কোলাজ
ক্রীড়া প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:৩১ | আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ১০:৫৬
পড়ন্ত বিকেলে নিজের কক্ষে বসেই খবরটা পেলেন বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ। দুর্বার রাজশাহীর বিদেশি ক্রিকেটারদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। কারণ, বিমানের টিকিটের অভাবে বিদেশি ক্রিকেটারদের কারও নিজ দেশে ফিরতে বিলম্ব হলে বড় কেলেঙ্কারি বাধবে। তাই ফারুক আহমেদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর নিলেন রায়ান বার্ল, মোহাম্মদ হারিস, কোচ ইজাজ আহমেদরা টিকিট হাতে পেয়েছেন কিনা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিগুয়ের কামিন্সের টিকিটের ব্যাপারে আলাদা করে জানতে চাইলেন। বিসিবি সভাপতির একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির অব্যবস্থাপনা নিয়ে মনোযোগী হওয়ার কারণ হলো বিপিএলে গত এক মাস নেতিবাচক অনেক কিছু ঘটেছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত হাতে সম্মানী না পেয়ে টিম হোটেল ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না দুর্বার রাজশাহীর বিদেশি ক্রিকেটাররা। দলের পাঁচ বিদেশির মধ্যে দু-একজন ২৫ শতাংশ অর্থ পেয়েছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, দুই সপ্তাহ ধরে দৈনিক ভাতাও দেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত গত রাতেই একজন দেশে ফিরে গেছেন। আজ আরও দু’জনের যাওয়ার কথা। তবে প্রতিশ্রুতির অর্থ হাতে পাননি তারা। এজেন্টের মাধ্যমে পরে তা দেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের।
এসব নিয়ে যা হলো, তা বাংলাদেশের আতিথেয়তার সুনামের সঙ্গে যায় না। এর দায় কি শুধুই রাজশাহীর ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক শফিকুর রহমানের। তাঁকে যারা এই দলের মালিকানা দিয়েছে, সেই বিসিবির কি কোনো দায় নেই? অবশ্য ব্যর্থতা স্বীকার করে দায়টা মেনে নিয়েছেন বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ। ‘রাজশাহী যা করেছে, একটি টুর্নামেন্ট শেষ করে দিতে তারাই যথেষ্ট। ভাবমূর্তি খারাপ হয়েছে, স্বীকার করে নিচ্ছি। তবে এখান থেকে বের হয়ে আসব। আগামী বিপিএল দেখবেন।’ শনিবার সাংবাদিকদের সামনে এভাবেই পরের বিপিএল নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন ফারুক আহমেদ।
সুর সেই সাবেক বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের মতোই! তিনিও প্রতিবার বিপিএল শেষে বলতেন পরের মৌসুম ভালো হবে। অথচ তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় ভালো বিপিএল নষ্ট হয়েছে একটু একটু করে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফারুক আহমেদ সেটাকে টেনে তুলতে চেয়েও ব্যর্থ হলেন ফ্র্যাঞ্চাইজিদের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায়। বিপিএলে নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নির্দিষ্ট একটা পরিমাণ অর্থ ব্যাংক গ্যারান্টি হিসেবে বিসিবিকে দিতে হয়। কিন্তু এবার বেশির ভাগ দলই সেটা দেয়নি।
এমনই কিছু ঘটনা শুধু ক্রিকেট না, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করেছে। রাজশাহীর ক্রিকেটারদের টাকা না পাওয়া, টাকা না পেয়ে দলের বিদেশি ক্রিকেটারদের ম্যাচ বয়কটের মতো ঘটনাও ঘটেছে। শেষের দিকে এসে পেমেন্টকে ছাপিয়ে গেছে ‘ফিক্সিং ইস্যু’। এককথায় তারুণ্যের বিপিএলে কলেঙ্কের দাগ লেগেছে পরতে পরতে। বিসিবি সভাপতি আশা করছেন, ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ক্রিকেটারদের সিংহভাগ টাকা পরিশোধ করতে চাপ দেওয়া হবে। ‘টিকিটিং মানির’ লভ্যাংশ রাজশাহীর খেলোয়াড়দের বকেয়া পরিশোধে ব্যয় করা হবে বলে জানান তিনি। লিগ পর্বে বিদায় নেওয়া রাজশাহীর ক্রিকেটাররা হতাশা নিয়েই ঘরে ফিরেছেন। তবে বেশি হতাশ হয়েছেন বিদেশিরা। কারণ বিপিএল খেলতে এসে এত বাজে অভিজ্ঞতার মুখে আগে কখনও পড়তে হয়নি তাদের। সেদিক থেকে সমর্থকরা বলতেই পারেন, তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরছেন রাজশাহীর বিদেশি ক্রিকেটাররা।
বিসিবি ও সরকার থেকে বলা হয়েছিল, সেরা বিপিএল হবে এবার। বিদেশ থেকে বৈশ্বিক তারকা উড়িয়ে এনে বিপিএলকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব নাজমুল আবেদীন ফাহিম। তাঁর সে স্বপ্ন মাঠে মারা গেছে অঙ্কুরেই। বিদেশি তারকা দূরে থাক, দেশের বড় কোনো তারকাকে দেখা যায়নি মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে। তবে নেতিবাচক প্রচারের দিক থেকে এবারের বিপিএল সেরা। বিপিএলকে জাঁকজমক করতে হলে যে রকম দক্ষ সংগঠকের প্রয়োজন ছিল, বিসিবির বর্তমান কমিটিতে তা নেই। যে কারণে ফারুক নিজেই বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। সদস্য সচিব নাজমুল আবেদীন টুর্নামেন্টের বেশির ভাগ ঘটনার খোঁজই রাখেন না। বর্ষীয়ান এ পরিচালকের কাছে কোনো তথ্য জানতে চাইলে বেশির ভাগ সময়ই বলেন, ‘আমি তো জানি না।’ অথচ গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব হিসেবে বিপিএলের সব তথ্য তাঁর নখদর্পণে থাকার কথা।
দেশের ক্রান্তিকালে বিপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি সীমিত করার পরামর্শ থাকলেও সেটা গ্রহণ করেননি গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব। ফলে ভালোর সঙ্গে দুটি বিতর্কিত ফ্র্যাঞ্চাইজি মিশে গেছে খুব সহজেই। ভ্যালেন্টাইন গ্রুপের এমডি শফিকুর রহমানের আর্থিক সক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদা যাচাই-বাছাই না করেই দুর্বার রাজশাহীর ফ্র্যাঞ্চাইজি করা হয়। এই দলের সঙ্গে বিতর্কিত বেশ কযেকজন জড়িয়ে পড়েন। গুঞ্জন আছে, শফিকুর রহমানকে ‘ছায়া মালিক’ বানিয়ে তাঁর পেছনে ছিলেন বিসিবি ঘনিষ্ঠ কিছু ক্লাব কর্তা ও সাবেক ক্রিকেটার। ঢাকা লিগে ক্রিকেটারদের সম্মানীর টাকা না দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ক্লাব কর্মকর্তাকেও যুক্ত থাকতে দেখা গেছে রাজশাহীর সঙ্গে। বিতর্কিত সাবেক ক্রিকেটারও যুক্ত ছিলেন। ক্রিকেটারদের সম্মানী সময়মতো পরিশোধ না করার পেছনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের হাত রয়েছে বলে মনে করেন ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টরা।
বিপিএলের শুরুতেই ক্রিকেটার ও কোচিং স্টাফের চুক্তির ৫০ শতাংশ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও রাজশাহী নিয়ম মানেনি। সিলেট পর্বে চেক দেওয়া হলেও তা বাউন্স করে। বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদের চেষ্টায় ২৫ শতাংশ টাকা পান খেলোয়াড়রা। ঢাকার দ্বিতীয় পর্বের আগে টাকা নিয়ে বিদ্রোহ হয়। ফলে বিদেশি ক্রিকেটারদের ছাড়া রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে হয় তাসকিনদের। সে ম্যাচে জেতার পর সিনিয়র ক্রিকেটারদের দ্বিতীয় ২৫ শতাংশ টাকা দেওয়া হলেও বেশির ভাগ ক্রিকেটারের চেক দ্বিতীয়বার বাউন্স করেছে।
ক্রিকেটারদের বকেয়া পরিশোধ করা নিয়ে শনিবার রাজশাহীর ফ্র্যাঞ্চাইজি স্বত্বাধিকারী শফিকুর রহমানকে বোর্ডে ডেকে আনা হয়েছিল। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জনসমক্ষে শফিকুরকে কড়া ভাষায় নির্দেশনা দিয়েছেন টাকা পরিশোধের। এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনি প্রক্রিয়ায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়ে দেন তিনি। তবে বিতর্কের মাঝে ভালোও আছে। চিটাগং কিংসকে বাদ দিলে সুপার ফোরের তিন ফ্র্যাঞ্চাইজি রংপুর রাইডার্স, ফরচুন বরিশাল ও খুলনা টাইগার্সের ক্রিকেটারদের পেমেন্ট ভালো। ঢাকা ক্যাপিটাল ভালো করতে না পারলেও পারিশ্রমিক ইস্যুতে বিতর্কে জড়ায়নি। মিডিয়ার নজর এড়িয়ে গেলেও সিলেট স্ট্রাইকার্সের নানা ঘটনা চাপা পড়ে গেছে দলের ব্যর্থতায়।
- বিষয় :
- খেলা-ক্রিকেট