ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

নাব্য সংকটে নৌবন্দরের অচলাবস্থা, শ্রমিক-ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন

নাব্য সংকটে নৌবন্দরের অচলাবস্থা, শ্রমিক-ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন

ছবি: সমকাল

ফরিদপুর অফিস

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২২ | ০৩:৩০ | আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২২ | ০৩:৩০

ফরিদপুরের পদ্মা নদীতে আবারও নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। নদীর মাঝে জেগে ওঠা ছোট-বড় অসংখ্য ডুবোচরের কারণে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো ও বড় ট্রলার চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা এসব পণ্যবাহী জাহাজ সিঅ্যান্ডবি ঘাট নৌবন্দরে ভিড়তে পারছে না। অচল হতে বসেছে জেলার একমাত্র নৌবন্দর হিসেবে পরিচিত সিঅ্যান্ডবি ঘাট। বেকার হয়ে পড়েছে হাজারো শ্রমিক-ব্যবসায়ী। নৌবন্দরের অচলাবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।

এদিকে বুধবার দুপুরে ফরিদপুরের সিএ্যান্ডবি ঘাট নৌ বন্দরের অচলাবস্থা দূরীকরণে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা।

নৌবন্দর এলাকায় কর্মসূচি পালনকালে শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুর রহিমের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ, জাহাজ মাস্টার সাদেক মোল্লা, মামুন ফকির, ইউপি সদস্য মনোয়ার ফকির, স্থানীয় বাসিন্দা রহিম জোয়াদ্দার প্রমুখ।

জাহাজ মাস্টার সাদেক মোল্লা বলেন, নদীতে নাব্য সংকটে তাদের জাহাজ চালাতে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জাহাজ চালাতে না পারায় বেকার হয়ে পড়েছেন। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকার উপক্রম হয়েছে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, নদীর দুটি স্থানে ড্রেজিং করা হচ্ছে। কিন্তু মূলত যে স্থানে ড্রেজিং করার কথা সেখানে না করে অন্যত্র ড্রেজিং করার কারণে নদীর নাব্য সংকট চরমে পৌছেছে। ফলশ্রুতিতে জাহাজ চলাচল করতে পারছে না, একইসঙ্গে জাহাজ চলাচল না করার কারণে জাহাজের শ্রমিক, মালিক ও ঘাটে কর্মরত শ্রমিকরা মারাত্মক অর্থকষ্টে সময় অতিবাহিত করছেন।

আরেকটি জাহাজের মাস্টার আকরাম হোসেন বলেন, নাব্য সংকটে জাহাজের ইঞ্জিনের পাখা ভেঙে যায়। সুখান আটকে যায়। জাহাজের অনেক ক্ষতি হয়। তিনি আরো বলেন, নদীতে অন্তত ১০ হাত গভীর পানি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে কোথাও কোথাও দুই-তিন হাত পানি রয়েছে।

নৌ বন্দরে কর্মরত শ্রমিক সেলিম হোসেন বলেন, কার্গো জাহাজ বন্দরে না ভীড়তে পারায় আমাদের মাল নামানোর কাজ কমে গেছে। নাব্য সংকটের কারনে আগের মতো এখন আর বন্দরে বড় জাহাজ আসেনা। শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই বেকার হয়ে গেছে। কাজ কমে যাওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিনপাত করতে হচ্ছে।

ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ বলেন, নৌবন্দরে ভিড়তে না পেরে অনেক দূরে দির্ঘীর চর, ভুঁইয়াবাড়ি ঘাট, খুশির বাজার, বাইল্যা হাটা, হাজিগঞ্জের চর, চরভদ্রাসনের এমপিডাঙ্গি ও গোপালপুরসহ বিভিন্ন স্থানে নদীর তীরে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো ও বড় ট্রলার ভেড়ানো রয়েছে। অনেক সময় ছিনতাইয়েরও ঘটনা ঘটছে।

তিনি আরও বলেন, গত ১৫ জানুয়ারি হতে ড্রেজিংয়ের কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। আমাদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মনোয়ার ফকির বলেন, এই ঘাটটি ফরিদপুরের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র হলেও দীর্ঘদিন ধরে ঘাটটি উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। ঘাটটি সঠিকভাবে চালাতে পারলে শ্রমিক, ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারও বিপুল অংকের রাজস্ব পাবে।

সিঅ্যান্ডবি ঘাটটি ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নে অবস্থিত। ডিক্রিরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদি হাসান মিন্টু বলেন, এখানে তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। ঘাটে আসার সড়কের অবস্থা এতটাই খারাপ বর্ষাকালে চলাচল অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি আরও বলেন, নাব্য সংকট দিন দিন প্রকট আকার ধারন করেছে। বেকার হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। বিষয়টি সমাধানে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেন তিনি।

ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, এছাড়া এখানে কোনো পাবলিক টয়লেট না থাকার কারণে সাধারণ জনগণের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। তিনি এখানে কমপক্ষে তিনটি পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা করার জন্য দাবি জানান। বন্দরটিকে ঘিরে হাজার হাজার শ্রমিক-ব্যবসায়ীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল। বন্দরটি অচল হলে শ্রমিকরা কাজ হারাবে, ফলে চুরি-ছিনতাই বৃদ্ধি পাবে।

জানা যায়, গত চার মাস পূর্ব থেকে পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করে। তখন থেকেই এসব নৌযানগুলো নাব্য সংকটের কবলে পড়ে সিঅ্যান্ডবি ঘাটের বন্দরে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে এই দুরাবস্থা চরমে পৌঁছেছে। বর্তমানে নাব্য সংকট রক্ষায় কয়েকটি স্থানে বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজার মেশিন বসিয়ে খনন কাজ করছে। তবে খননের কয়েকদিনের মধ্যেই আবার বালু এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।

দক্ষিণবঙ্গসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্যবসায়ীক পণ্য আনা নেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নৌবন্দরটি শত বছরের প্রাচীন। ২০১৭ সালে সরকার এটিকে তৃতীয় শ্রেণির নৌবন্দরের অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নৌ পথে এই বন্দরে পণ্য আনা নেওয়া করা হয়।

ফরিদপুরের সোনালি আঁশখ্যাত পাট এই বন্দর হয়েই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়। এছাড়াও সিলেট থেকে কয়লা ও বালু, ভারতের গরু ও চালসহ চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মিরকাদিম থেকে এই নৌ পথেই চাল আমদানি হয়। নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকে প্রচুর সিমেন্টবাহী জাহাজ ও কার্গো এই বন্দর থেকে খালাস করা হয়। বর্তমানে নদীতে নাব্য সংকট এবং অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় এসব পণ্যবাহী নৌযান বন্দরে আসতে পারছে না।

শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, দক্ষিণবঙ্গসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্যবসায়িক পণ্য আনা নেওয়ার জন্য এই নৌবন্দরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বছরের পাঁচ মাসের মতো সময় এখানে পানি কম থাকে বিধায় বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতা সৃষ্টি হয়।

তিনি আরও বলেন, গত একমাসে পদ্মার বুকে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য বন্দরমুখী পণ্যবাহী বেশ কিছু জাহাজ আটকা পড়েছে। শ্রমিকরা প্রায় বেকার হয়ে পড়েছে। কাজ কমে যাওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিনপাত করতে হচ্ছে।

এদিকে নৌবন্দরের শুল্ক আদায়ও কমে গেছে। এছাড়াও এসব নৌযান থেকে পণ্য খালাস করতে অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হচ্ছে। পণ্যবাহী নৌযানের মালিকরা ও পণ্য আমদানিকারকরা চরম বিপাকে পড়েছেন। তাছাড়া নৌবন্দর এলাকার শ্রমিকরা বেকার হতে বসেছে। এছাড়াও দিনের পর দিন অরক্ষিত স্থানে জাহাজ, কার্গোগুলো থাকায় পড়তে হচ্ছে বিবিধ সমস্যায়।

এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র (আরিচা নৌ বন্দর) উপ-পরিচালক শাহ আলম বলেন, নৌবন্দরটিকে সচল করতে নৌচ্যানেলে ড্রেজিং করা হচ্ছে। ড্রেজিংয়ের কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং বিভাগ। নাব্য সংকট উত্তরণে ড্রেজিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে। একটু সময় লাগবে। 

তিনি বলেন, নৌ বন্দরের অচলাবস্থা দূরীকরেন সিএ্যান্ডবি ঘাটের শ্রমিক-ব্যবসায়ীদের মানবন্ধনের বিষয়টি জেনেছি। চেয়ারম্যান স্যারকে বিষয়টি অবগত করেছি। দ্রæত ড্রেজিং সম্পন্নর ব্যবস্থা করা হবে।

আরও পড়ুন

×