সুনামগঞ্জে পানির নিচে ৫ হাওর
'অখন খাইয়া বাঁচতাম কিলা'

সিলেটের গোয়াইনঘাটে পাহাড়ি ঢলে ডাউকি নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। সোমবার উপজেলার আসামপাড়া এলাকার ছবি -সমকাল
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২২ | ০০:০৬
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ডুবে যাওয়া ছোট কানলার হাওরপাড়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন ষাটোর্ধ্ব পারভিন বেগম। তিনি বলছিলেন, 'অখন বাইচ্ছা-কাইচ্ছা লইয়া খাইয়া বাঁচতাম কিলা'।
বিরামপুরের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলছিলেন, 'ছয় মাস ক্ষেতে কাম করছি, অখন কোনো গুছাত ধান বাড়াইছে, কোনোটাত বাড়াইছে না, কয়েক দিন ধইরা জমিনের দিকে চাইয়া চাইয়া কাটাইছি, আর ছয়-সাত দিন গেলেই ধান কাটা গেল নে, সকালে ঘুম থাকি উইট্টা গিয়া দেখি, সব ক্ষেত ডুবি গেছে। ঋণ কইরা ৩৫ হাজার টেকা আইন্না ক্ষেত করছি, অখন ঋণ কিলা দেই।' শুধু পারভিন ও জাহাঙ্গীর নন, অনেক কৃষক এমন দুরবস্থার মধ্যে পড়েছেন।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, ছোট কানলার হাওরে দুই থেকে তিনশ হেক্টর জমি আছে। কোনো ধানই পাকেনি। সোমবার সকালে সুরমা নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে বড় কানলার হাওরের এই অংশে (ছোট কানলা) ঢুকে পড়েছে।
এ নিয়ে গত তিন দিনের উজানের ঢলে (ভারতের মেঘালয়-চেরাপুঞ্জি থেকে নেমে আসা পানি) কয়েকটি ছোট হাওর ডুবেছে। হাওরগুলো হলো- তাহিরপুরের টাঙ্গুয়া, সুনামগঞ্জ সদরের ছোট কানলা এবং ছাতকের গুয়া পাকুয়া, শাল্লার বাঘার হাওর ও কলার হাওর।
নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার বড় ৪২টি হাওরসহ ছোট-বড় প্রায় দেড়শ বোরো ফসলের হাওর হুমকিতে পড়েছে। দিরাইয়ের বরাম হাওর, তাহিরপুরের গুরমা এক্সটেনসন, মাটিয়ান হাওর, বিশ্বম্ভরপুরের করচা, জামালগঞ্জের হালির হাওরসহ সীমান্ত উপজেলার নদীতীরবর্তী হাওরের ফসল রক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষক।
গতকাল বিকেলে শাল্লা উপজেলার বাঘার হাওরে নদীর পানি প্রবেশ করে। কৃষকদের চোখের সামনেই ডুবে যায় ধান। এই হাওরের ৮০ ভাগ জমি চাষাবাদ করেন দামপুরের কৃষকরা। কিছু জমি রয়েছে খল্লি গ্রামের কৃষকদের।
খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তালেব, ভাইস চেয়ারম্যান দীপু রঞ্জন দাস ও কৃষি অফিসের লোকজন হাওরে যান। কিন্তু প্রবল স্রোতের কারণে বাঁধ রক্ষা করা যায়নি।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গতকাল বিকেলে শাল্লার দাড়াইন নদীতে ৬ ইঞ্চি পানি বেড়েছে। ২-৩ দিন এভাবে পানি বাড়লে ছোট ছোট অনেক হাওর তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই হাওরগুলো হলো- শাল্লা সদরের জোয়ারিয়া, কৌইয়া, কোনারবন, পুইট্টা ও নাইপতার চর।
শাল্লা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দীপু রঞ্জন দাস বলেন, বাঘার হাওরটি রক্ষা করা যায়নি। নদীর পাড় নিচু হওয়ায় পানির প্রবল চাপে বাঁধ ভেঙে যায়। এই হাওরে ৪০০-৫০০ একর জমি ছিল বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।
শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তালেব বলেন, নদীর পানি দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় বাঘার হাওরটি তলিয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন গতকাল জেলা হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মনিটরিং কমিটির জরুরি সভায় সংশ্নিষ্ট সবাইকে ফসল রক্ষা বাঁধে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
নেত্রকোনায় ধনু নদীর পানি বৃদ্ধি, তলিয়ে গেছে বোরো ফসল : নেত্রকোনার ধনু নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে খালিয়াজুরী উপজেলা সদরে চুনাইর হাওরে বেড়িবাঁধ না থাকায় পানি প্রবেশ করেছে। একমাত্র ফসল হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
পাহাড়ি ঢলে গোয়াইনঘাটে ফের বন্যা : কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ১০ দিনের ব্যবধানে সিলেটের গোয়াইনঘাটে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে তলিয়ে গেছে কৃষকের সহস্রাধিক হেক্টর জমির বোরো ধান। এ ছাড়া কোনো কোনো এলাকার রাস্তাঘাট ভেঙে এবং পানিতে তলিয়ে থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ইটনা ও মিঠামইনের হাওরে বাঁধ ভাঙন : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মিঠামইন ও ইটনার হাওরে নতুন করে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার বোরো ধান। মিঠামইনের হাঁটুরিয়া নদীর তীর তলিয়ে ২০০ একর বোরো ফসল এখন পানির নিচে। ইটনায় ফসল রক্ষা বাঁধ রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন স্থানীয়রা।
বিশেষ উদ্যোগের দাবি সংসদে : আর কয়েক দিনের মধ্যে হাওরের ফসল ঘরে ওঠার কথা থাকলেও এখন হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির এমপি পীর ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, পানিসম্পদ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচিত সব কিছু বাদ দিয়ে ফসল রক্ষা করা। গতকাল সংসদের বৈঠকে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে অনির্ধারিত আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। এর আগে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়।
সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে না জানে, তা খুবই দুঃখজনক। কেন শিক্ষার্থীরা জানবে না, গলদটা কোথায়? ভুলটা কোথায়?
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন সুনামগঞ্জ থেকে পঙ্কজ দে, কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থেকে বিজয় কর রতন, সিলেটের গোয়াইনঘাট থেকে জাকির হোসেন, নেত্রকোনা থেকে খলিলুর রহমান শেখ এবং ঢাকা থেকে মসিউর রহমান খান)