শেরপুরের নালিতাবাড়ী
আকাশচুম্বী মজুরি বিপাকে কৃষক

মিজানুর রহমান, নালিতাবাড়ী (শেরপুর)
প্রকাশ: ০৯ মে ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৯ মে ২০২২ | ২৩:৫৯
ধান কাটা শ্রমিকদের আকাশচুম্বী মজুরির কারণে বিপাকে পড়েছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কৃষকরা। ভরা বোরো মৌসুমে পাকা ধান মাঠে রেখে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাদের। তারা বলছেন, ঝড়-তুফানের মৌসুমে দ্রুত ধান কাটতে না পারলে ফসলের ক্ষতি হবে। শিলাবৃষ্টি নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। তাদের কণ্ঠে বেশি অসহায়ত্ব ধরা পড়ে শ্রমিকরা উচ্চ মজুরি হাঁকানোয়।
গতকাল সোমবার ভোরে উপজেলার বালুঘাটা বাজার থেকে ১০ জন শ্রমিক নিতে আসেন তারাকান্দি গ্রামের চাষি আবুল হাসেম। এ সময় শ্রমিকদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে দেখা যায় তাকে। শ্রমিকরা জনপ্রতি মজুরি চাইছিলেন এক হাজার ৪০০ টাকা। তিনি তখন ৫০ টাকা কমে যাওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করেন। তবে এতে মন গলেনি শ্রমিকদের। অবশেষে বাধ্য হয়ে এক হাজার ৪০০ টাকা রোজে ১০ জন শ্রমিককে নিয়ে যান ধান কাটাতে।
কৃষকরা বলছেন, ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক পাওয়া যেন তাদের কাছে হাতে সোনার হরিণ পাওয়ার মতো ব্যাপার। দিনপ্রতি প্রতি শ্রমিককে এক হাজার ৪০০ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি তিন বেলা খাবার দিতে হয়। সেই সঙ্গে ধূমপায়ী শ্রমিকদের জন্য সরবরাহ করতে হয় বিড়ি-সিগারেটও। এতে আরও ১৫০ টাকার মতো বাড়তি খরচ হয়। একসঙ্গে বেশিরভাগ জমির ধান পেকে যাওয়ায় শ্রমিকরা উচ্চ মজুরি হাঁকাচ্ছেন বলে জানান তারা। এতে এক রকম অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা।
কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলার ২২ হাজার ৭৫৬ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। ঝড়-বৃষ্টির মৌসুমে তা কতটুকু হবে- তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা।
কৃষকরা জানিয়েছেন, প্রতি একর জমির ধান কাটতে ২০-২৫ হাজার টাকায় চুক্তি করছেন শ্রমিকরা। একরপ্রতি ধান উৎপাদন হতে পারে ৫০-৬০ মণ। বর্তমান বাজারে মণপ্রতি ধানের দাম ৭০০-৮০০ টাকা। সে হিসাবে ধান উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে বলে জানান তারা।
আন্ধারুপাড়া গ্রামের কৃষক হাবিল উদ্দিন বলেন, 'সময়-সুযোগ বুঝে অন্য পেশার লোকজনও এখন ধান কাটার কাজে লেগেছেন। মনমতো অতিরিক্ত দরে ধান কাটছেন। এতে আমরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। লোকসান জেনেও ধান কাটাতে হচ্ছে।' সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে ক্ষতি থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেতেন বলে মনে করেন তিনি।
তারাকান্দির চাষি আবুল বাশার বলেন, 'কামলার দাম (মজুরি) বেশি থাকায় এক একর ক্ষেতের (জমি) ধানও কাটতে পারতাছি না।' ঝড়-তুফান ও শিলাবৃষ্টির শঙ্কায় রাতে ঘুম আসে না তার। বাধ্য হয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিছু ধান কাটছেন বলে জানান।
বাশার আরও বলেন, 'যা ধান হইছে, তা ঘরে তোলা নিয়াও দুশ্চিন্তায় আছি। জমি করতে অনেক কষ্ট অয়।' সারা বছরের পরিশ্রমের ফল এই ধানের দাম যদি ঠিকমতো না পান, তবে কীভাবে বাঁচবেন- সেই প্রশ্নও ছুড়ে দেন। সরকারের প্রতি ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের আকুতি জানান এই চাষি।
বাড়তি মজুরি হাঁকার বিষয়ে শ্রমিকদের ভাষ্য, সংসার চালাতে, সন্তানদের পেছনে তাদেরও খরচ বেড়েছে। বাধ্য হয়ে বেশি মজুরি নিচ্ছেন তারা। বালুঘাটার শ্রমিক হাটে কথা হয় কৃষি শ্রমিক আব্দুল জলিল, ফারুক, কাইয়ুমসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের সবার কথা, এই মৌসুমে বাড়তি কিছু টাকা আয় করতে পারলে কিছুদিন ভালোভাবে চলতে পারবেন তারা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর কবির বলেন, শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে তারা ৫০ ভাগ ভর্তুকিতে মাড়াইযন্ত্র বিতরণ করেছেন। এর পরও এ যন্ত্র নিতে কৃষকদের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই। এ ছাড়া ১৫টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার মেশিন দিয়েছেন তারা। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত না হানলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
- বিষয় :
- মজুরি
- শ্রমিক
- বোরো মৌসুম
- ধান কাটা