অবৈধ গ্যাস সংযোগে পকেট ভরছে আ'লীগ-ছাত্রলীগ

শাহাদাত হোসেন রতন, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ)
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৩:৪৮
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। এ কারণে নতুন করে বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে সরকার। গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে শিল্পকারখানায়। কিন্তু উল্টো চিত্র দেখা গেছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বিভিন্ন গ্রামে চলছে অবৈধ সংযোগ দেওয়ার হিড়িক। সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান পরিচালনা হলেও এখনও অব্যাহত রয়েছে অবৈধ সংযোগ। এর নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
একদিকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও অন্যদিকে রাতের আঁধারে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে গত এক বছরে পাঁচবার হামলার শিকার হতে হয়েছে তিতাস কর্তৃপক্ষকে। এ হামলার জন্য সোনারগাঁ থানায় অভিযুক্তদের আসামি করে মামলা করা হয়। গত এক বছরে ১১টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান পরিচালনা করে তিতাস। এতে আবাসিক, রেস্টুরেন্ট, বেকারি, শিল্পসহ প্রায় ১৫ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে সোনারগাঁয়ে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দেওয়া শুরু হয়। এ জোনে প্রায় ৩২ হাজার বৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মেঘনাঘাট জোনে ৭ হাজার। তবে বৈধ গ্যাস সংযোগের চেয়ে অবৈধ প্রায় তিন গুণ। গ্যাসের অপচয় হওয়ার কারণে বৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীদের গ্যাস সংকটের হাহাকার করতে হচ্ছে। মেঘনাঘাট জোনে বৈধ শিল্প সংযোগ রয়েছে ৫৭টি। এর মধ্যে ৩৫টি চলমান রয়েছে। ২২টি সংযোগ বকেয়া ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া সেগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। সিএনজি স্টেশন ১৫টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ রয়েছে ৮ থেকে ১০টি।
অন্যদিকে, সোনারগাঁ জোনের আওতায় প্রায় ৫০ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। শুধু মেঘনাঘাট জোনেই রয়েছে প্রায় ১৫-১৬ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ।
সোনারগাঁ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে সনমান্দি ও সাদিপুর ইউনিয়নে অবৈধ গ্যাস সংযোগের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। সনমান্দি ইউনিয়নে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস সংযোগ লাইন স্থাপন করা হয়েছে। সাদিপুর ইউনিয়নে প্রায় ২০ কিলোমিটার গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এ অবৈধ গ্যাসলাইন থেকে রাইজারপ্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে গড়ে ৩৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা করে। শাসক দলের স্থানীয় নেতারা এ গ্যাস সংযোগের পেছনে রয়েছেন বলে জানান এলাকাবাসী। শাসক দলের লোকজন ছাড়াও এ কাজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নামও উঠে এসেছে। তিতাসের অনুমতি ছাড়াই এসব সংযোগ দেওয়া হয়।
গত এক বছরে সোনারগাঁয়ে ১১টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নোয়াইল এলাকায় প্রায় ৩ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। গত ১১ আগস্ট পিরোজপুর ইউনিয়নের পিরোজপুর ও প্রতাপের চর এলাকার দুটি চুনা কারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এ ছাড়া ৩০ আগস্ট দুলালপুর এলাকায় সহস্রাধিক আবাসিক অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর চান্দেরকীর্তি এলাকায় প্রায় ৭ হাজার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
সরেজমিন বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে জানা যায়, সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাট কেটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসানো হয়েছে গ্যাসের অবৈধ পাইপলাইন। তবে কিছু কিছু স্থানে গ্যাস পাইপলাইন মাটির ওপর দিয়েও নেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব লাইন নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন এলাকাবাসী। যে কোনো সময় ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) আবাসিক গ্যাস সংযোগ বৈধ করার ঘোষণা দেয়। ওই ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন স্থানে অবৈধ গ্যাস সংযোগের হিড়িক পড়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া ও শম্ভুপুরা ইউনিয়নে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সোহাগ রনি, স্থানীয় ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা মজিবুর রহমান এবং আশেক আলী। তিতাস গ্যাসের ঠিকাদার পরিচয়দানকারী জাহাঙ্গীর, পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ও আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ হোসেন, সাদিপুরে আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল মাস্টার, ইসমাইল মেম্বার, শামসুল হক মেম্বার, আমির হোসেন, মনির মেম্বার, নোয়াগাঁও ও বারদী ইউনিয়নের থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আজিমুদ্দিন, জামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া, সনমান্দি ইউনিয়নে তাহের আলী, বিদ্যু মেম্বার, মতিউর রহমান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুরু মিয়া, হোসেন মেম্বার, জসীম উদ্দিন, শাহাবুদ্দিন সরকার, বাচ্চু সরকার, ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী, মনির হোসেন, রমজান, আনোয়ার, বৈদ্যেরবাজার ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা আমির হোসেন, বারদী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি জহিরুল হক, জাতীয় পার্টির নেতা আনোয়ার হোসেন আনু, সাবেক ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম, শ্রমিক লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য নাজমুল হকসহ আরও অনেকে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীর সমন্বয়ে কমিটি করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব গ্যাস সংযোগ থেকে উপার্জিত টাকা সবাই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
অভিযুক্ত মোশারফ মেম্বার জানান, এক সময় আমি জড়িত ছিলাম। এখন আমি জড়িত নই।
দরপত গ্রামের কৃষক সোবহান মিয়া বলেন, এ এলাকায় এক সময় গ্যাস পেয়েছিলাম। অবৈধ হওয়ায় কেটে দেওয়া হয়েছে। আশা করি, সরকার দ্রুত আবাসিকে বৈধ গ্যাস সংযোগ দেবে।
জামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, 'এক সময় আমি গ্যাস সংযোগের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আমি এর মধ্যে আর নেই।'
বারদী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান জহিরুল হক বলেন, জনগণের চাহিদা থাকার কারণে ওই সময়ে গ্যাস সংযোগ আনা হয়েছিল। পরে তিতাসের লোকজন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর আর চেষ্টা করা হয়নি।
তিতাসের মেঘনাঘাট জোনের ব্যবস্থাপক মেজবাহউর রহমান বলেন, তিতাস গ্যাস সংযোগের জন্য কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন ইউনিয়নের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন শাসক দলের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে এ গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। অবৈধ সংযোগের সঙ্গে জড়িত থাকায় তিতাসের দুই কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
তিতাসের সোনারগাঁ আঞ্চলিক জোনের বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মো. সুরুজ আলম জানান, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের বাণিজ্যিক সংযোগ থেকে অবৈধভাবে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়েছে। গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে অবৈধ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
- বিষয় :
- অবৈধ গ্যাস সংযোগ