বিশ্ব নদী দিবস
নদীর মায়ায় পড়ল না কেউ

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ২৩:৩৮
'ও নদীরে/ তুই যাস কোথায় রে/ কলকলাইয়া ছলছলাইয়া কোন সাগরে'- রেনেসাঁ ব্যান্ড দলের জনপ্রিয় গানের 'প্রাণবন্ত নদী'র দেখা মিলছে না কোথাও। দখল, দূষণ ও অদূরদর্শিতায় বিপর্যস্ত বন্দরনগরীর প্রতিটি নদী।
চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলীতে প্রতিদিন শুধু প্লাস্টিক ও পলিথিনজাতীয় বর্জ্য পড়ছে ২৪৯ টন। মেডিকেল বর্জ্য পড়ছে ১০ টন। পড়ছে ৬০ লাখ মানুষের পয়ঃবর্জ্য। মিশছে ইটিপি না থাকা ১১ শিল্পকারখানার বর্জ্যও। নদীতে চলাচল করা প্রায় দেড় হাজার লাইটারেজ জাহাজ-ট্রলারের বর্জ্যও নিত্যসঙ্গী কর্ণফুলীর।
আরেক প্রাকৃতিক নদী হালদাও ভালো নেই। দখল-দূষণে সেখানেও হুমকিতে জীববৈচিত্র্য। গত চার বছরে এই নদীতে শুধু ডলফিনই মরেছে ৩৮টি। এই নদী থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ২০ প্রজাতির মাছও। শুধু দূষণ নয়, এ নদীর জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে দখলও। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে নদীর তীরে একের পর এক গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা। আদালতের নথিতে এই সংখ্যা ২ হাজার ১৮১ হলেও বাস্তবে তা ১০ হাজারের বেশি হবে বলে মনে করছেন খোদ নদী গবেষকরা।
জানতে চাইলে কর্ণফুলী নদীর গবেষক ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, 'নদী জীবনের বাহক। নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ; বাঁচবে মানুষ। কিন্তু আমরা এটি ভুলে বসে আছি। কেপিএম, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম ওয়াসা, সিইউএফএল-কাফকো এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদীদূষণ করে চলেছে। ইটিপি থাকার পরও তা ব্যবহার না করে তরল বর্জ্য প্রতিনিয়ত কর্ণফুলীতে ফেলছে কিছু শিল্পকারখানা। নগরের ৬০ লাখ অধিবাসীর পয়োবর্জ্যও হজম করতে হচ্ছে কর্ণফুলীকে। এ জন্য হুমকির মুখে আছে এখানের জীববৈচিত্র্য। কর্ণফুলী নদীর দু'পাড়ে চলছে দখলের মহোৎসবও।' কর্ণফুলীর মোহনায় বে-টার্মিনাল, লালদিয়ার চর এলাকায় কেসিটি টার্মিনাল ও নাব্য বাড়াতে কর্ণফুলীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে নদীর অবস্থা আরও বেহাল হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
হালদা নদী বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়ার ভাষ্য, 'কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে হালদা নদী বাংলাদেশের অদ্বিতীয় নদী। কেবল এই নদীতেই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ডিম ছাড়তে আসে রুই-মৃগেল ও কার্পজাতীয় মাছ। কিন্তু দূষণের কারণে হালদাও আজ বিপর্যস্ত। এতে হুমকিতে পড়ছে মা মাছ। মারা যাচ্ছে একের পর এক ডলফিনও।' গত চার বছরে বিভিন্ন কারণে ৩৮টি ডলফিন মারা যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, 'এটি অশনিসংকেত। কারণ ২০ প্রজাতির মাছও হুমকির মুখে আছে হালদায়।'
ফাইলবন্দি কর্ণফুলী রক্ষার আট দফা সুপারিশ
কর্ণফুলীতে জীববৈচিত্র্য ঠিক রাখতে আটটি সুপারিশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল। মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক আয়েশা আক্তার এবং পরিবেশ ও বনবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-আমিন গবেষণাটি পরিচালনা করেন। কিন্তু তাঁদের সেই সুপারিশ ফাইলবন্দি হয়েই রয়েছে।
নজর নেই দূষণ পয়েন্টে
কর্ণফুলীর জন্য মাস্টারপ্ল্যান করার আগে দূষণের পয়েন্ট চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তর। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- রুবি সিমেন্ট কারখানার পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত খাল, মাইজপাড়া এলাকা থেকে কর্ণফুলীতে সংযুক্ত খাল, মহেশ খাল, মুরারী খাল, বোয়ালখালী খাল, রাজাখালী খাল, চাক্তাই খাল ও খন্দখিয়া খাল দিয়ে সবচেয়ে বেশি দূষিত হয় নদীটি। ইটিপি না থাকা টিএসপি কমপ্লেক্স, ইস্টার্ন রিফাইনারি, ডিউ ড্রপ, চিটাগং ওয়াশ, মেঘনা সি ফুড, বে ফিশিং, ইলিয়াছ ব্রাদার্স (এডিবল অয়েল রিফাইনারি), ডিওটিটি অয়েল রিফাইনারি, কর্ণফুলী পেপার মিলস, বনলতা ওয়াশিং, আল্লামা ওয়াশিং, ম্যাক পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলের তরল বর্জ্যও দূষণ ছড়াচ্ছে কর্ণফুলীতে। কিন্তু এসব পয়েন্টে দূষণ ঠেকাতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি কেউ-ই।
দখল বাড়ছে দুই তীরে; উদ্বেগের চিত্র জরিপে'কর্ণফুলী নদীর তলদেশের গভীরতা ও দখল জরিপ ২০২২' শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল। এই জরিপের তথ্য তুলে ধরে 'কর্ণফুলী নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন'-এর সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান জানান, ২০০০ সালে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল ৯৩০ দশমিক ৩১ মিটার। কিন্তু বর্তমানে এ নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ৪১০ মিটার। অর্থাৎ গত ২২ বছরে নদীতে চর জেগে বিলীন হয়ে গেছে ৫০০ মিটারের বেশি এলাকা। চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এ জরিপ চালানো হয়।
হালদা রক্ষার ১১ দফাও অন্ধকারে কারখানার বর্জ্য, মুরগির খামারের বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য এবং স্যুয়ারেজ বর্জ্যের কারণে দূষণের শিকার হচ্ছে হালদা নদী। পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি প্রতিবেদন এই দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য দিয়েছে ১১ দফা সুপারিশ। কিন্তু আলোর মুখ দেখছে না এসব সুপারিশও।
- বিষয় :
- বিশ্ব নদী দিবস
- কর্ণফুলী
- হালদা নদী