ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ম্রোদের ঘরে আগুন: খোলা আকাশের নিচে রাত কাটলো তাদের

ম্রোদের ঘরে আগুন: খোলা আকাশের নিচে রাত কাটলো তাদের

রোববার মধ্যরাতে ম্রোদের ঘর পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ছবি - সমকাল।

বান্দরবান প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৫:৪২ | আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৬:০৭

পাহাড়ে কনকনে ঠান্ডা। বিরান মরুর মতো উঠোনে পোড়া কাঠ-কয়লার স্তূপ। তার সামনে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ পুরো পরিবারের রাত কেটেছে খোলা আকাশের নিচে। 

বান্দরবানের লামায় সরই ইউনিয়নের রেংয়েন কারবারী পাড়ার সোমবার রাতের চিত্র ছিল এটি। 

এর আগে রোববার মধ্যরাতে সেখানে রেং ইয়ুং ম্রো-সহ তিন বাসিন্দার ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ভাঙচুর করে আরও পাঁচটি ঘর। পাড়ার লোকজনের ওপর হামলা চালিয়ে লুটপাট করা হয় বলে অভিযোগ। 



রেং ইয়ুং ম্রো ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলেন, শীতে কাঁপতে কাঁপতে খোলা আকাশের নিচে রাত কেটেছে আমাদের। বাপের ভিটায় (পাড়াতে) বসবাস করতে পারব কিনা ভয়ে আছি।  

তিনি বলেন, লামা রাবার কোম্পানির লোকজন আমার ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। কী অপরাধ করেছি জানি না। আমার সন্তানরা কী করেছে? আমি গরিব মানুষ। দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আপনারা (সাংবাদিক) আমাদেরকে বাঁচান।

রেং ইয়ুং-এর স্ত্রী সংলে ম্রো কান্নাজড়িত কণ্ঠে ম্রো ভাষায় কথা বলেন। তা বাংলায় তর্জমা করে দেন তার স্বামী,  আমার মেয়ে অনেক কষ্টে দিনমজুরি করে ১১ হাজার টাকা জমিয়েছিল। ওই রাতে সেই টাকা তারা (দুর্বৃত্তরা) নিয়ে গেছে। সামান্য কিছু ধান, চাল ছিল, সেগুলোও পুড়ে গেছে। আমাদের ঘরের দা, কোদাল, মুরগি নিয়ে গেছে। 

রোববার মধ্যরাতে ম্রোদের ঘর পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ছবি- সমকাল। 

গত রোববারের ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে। ক্ষতিগ্রস্ত ম্রোদের অভিযোগের আঙুল রাবার কোম্পানিটির দিকে। এর আগেও লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ম্রো, ত্রিপুরাদের জায়গায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ করেন তারা। 

ওই রাতের ঘটনায় পুড়েছে বিধবা মাও রুম ম্রোর ঘরও। তার নতুন ঘরটি পাড়ার লোকজন টাকা, বাঁশ, কাঠ ও শ্রম দিয়ে তৈরি করে দিয়েছে। সিং চং ম্রোর ঘরও পুড়ে ছাই হয়েছে। লাং রুম ম্রোর নতুন ঘর ভেঙে মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। রেং য়ুং ম্রো ও তিতলিত ম্রোর ঘরও মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।

জানা গেছে, গত বছর ২৬ মার্চ ম্রো ও ত্রিপুরাদের ৩৫০ একর জায়গায় আগুন দেওয়া হয়। আগুনে পুরো এলাকা বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া বনভূমি সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো পাড়া, রেংয়েন ম্রো পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ায় বাসিন্দাদের। তিন পাড়ার ৩৬টি পরিবার তিন পুরুষ ধরে ওই এলাকায় বসবাস করে আসছে। 

ম্রো ও ত্রিপুরাদের অভিযোগ, ৪০০ একর ভূমি দখলের পাঁয়তারা করছে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ। সেখানে তারা রাবার ও কাজু বাদামের চাষ করবে।

সরই ইউনিয়নের রেংয়েন ম্রো পাড়ার কারবারী (পাড়ার প্রধান) রেংয়েন ম্রো বলেন, অনেক কষ্টে পাহাড়কে চাষযোগ্য, বাগান করার উপযোগী করে তুলেছি আমরা। এখন লামা রাবার কোম্পানি বলছে এই জায়গা তাদের। এই জায়গা আমাদের, কোম্পানির না। মরতে হলে এখানেই মরতে হবে আমাদের।

তিনি আরও বলেন, শুধু রোববারের ঘটনা নয়। এর আগেও রাবার কোম্পানির লোকজন আমাদের কলা গাছের বাগান কেটে নষ্ট করেছে। ছড়ার পানি পাড়ার লোকজন পান করে- ব্যবহার করে। সেই পানিতে বিষ দিয়েছে কোম্পানির লোক। রোববার রাতে কয়েকটি গাড়িতে করে দুইশ-আড়াইশ লোক এসে রাতে আগুন, হামলা ও ভাঙচুর করেছে।

এ ব্যাপারে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালক ইফতেখার আলম মজুমদার বলেন, আমাদের কাগজে-কলমে ১৬০০ একর জায়গা আছে। ১২০০ একর জায়গায় বাগান হয়েছে। বাকি ৪০০ একর জায়গায় বাগান সৃজনের কাজ চলছে। আমাদের জায়গায় এসে তারা (ম্রোরা) ঘর তৈরি করছে। থানায় অভিযোগ দেওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টি দেখেছে।

তিনি আরও বলেন, ম্রোরা এর আগে ঝিরিতে বিষ দেওয়ার পর ফেসবুকে ছবি দিয়ে হৈচৈ ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। নিজেদের বাগান নিজেরা নষ্ট করে ফেসবুকে ছবি দেয়। এখন তাদের বাড়িঘরে কারা হামলা, ভাঙচুর করেছে জানি না। ওই ঘটনায় আমাদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা চলছে। ঘটনাটি জানার পর আমার শ্রমিকদের বিষয়টি বিস্তারিত জানতে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলাম।

লামা থানা ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, রেংয়েন ম্রো পাড়ার ঘটনায় এখনো কেউ মামলা করতে আসেনি। শুনেছি ওই জায়গা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ আছে। মামলা হলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

লামা সরই ভূমি রক্ষা আন্দোলন কমিটির সভাপতি রুন্দ্রজন ত্রিপুরা বলেন, যারা হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। 

আরও পড়ুন

×