শেষ বেলায় পরাশ্রয়ী জীবন

শফিকুর ইসলাম ও সফুরা বেগমের ছবিটি সম্প্রতি তোলা - সমকাল
ইব্রাহীম খলীল, নবাবগঞ্জ (ঢাকা)
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১০:৩৭
পরিশ্রমী জীবন কাটিয়ে শেষ বেলায় পড়েছেন শফিকুর ইসলাম সরকার। কাগজে-কলমে বয়স ৬৮ হলেও দাবি করেন, আশির কোঠা পেরিয়েছেন। এই বয়সে যেখানে নাতি-নাতনির সঙ্গে অবসরে খুনসুটি করার কথা, তখন দীর্ঘ পথ হেঁটে চা বিক্রি করছেন শফিকুর। তাঁর সঙ্গে থাকেন স্ত্রী সফুরা বেগম। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তাঁর বয়স ৫১। যদিও দেখেই বোঝা যায়, সফুরা বেগমের বয়স কম করে হলেও ৬০।
কোনো ভিটেবাড়ি নেই ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা এ দম্পতির। উপজেলার বাহ্রা ইউনিয়নের সুভরিয়া গ্রামে এক আত্মীয়ের পরিত্যক্ত দোকানে পেয়েছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। সেখান থেকেই প্রতি সকালে চায়ের ফ্লাস্ক হাতে বের হন শফিকুর-সফুরা। সম্প্রতি কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, প্রতি কাপ চা ৫ টাকা করে বিক্রি করেন। কেউ কেউ বৃদ্ধ বিক্রেতা দেখে সহানুভূতি দেখিয়ে ১০-২০ টাকাও ধরিয়ে দেন। দিন শেষে সব মিলিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি আয় হয় না। এ দিয়েই খেয়ে, না খেয়ে কোনোমতে দিন কাটে।
এক সময় দিনমজুরি করতেন শফিকুর। এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তবে মাদকে আসক্ত ছেলের কারণে জীবনের দুর্ভোগ কমেনি। বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখভাল তো দূরের কথা, উল্টো মাঝে মধ্যেই নেশার টাকার জন্য হানা দেয়। মারধর করে টাকা-পয়সাও ছিনিয়ে নেয়। নানাভাবে ছেলেকে সংশোধনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে নিজেদের রাস্তা নিজেরাই খুঁজে নেন। চার বছর ধরে ফ্লাস্কে করে চা ফেরি করেন শফিকুর।
সফুরা বেগমের ভাতিজি শাহিন বলেন, 'আমার ফুপু-ফুপার থাকার জায়গা ছিল না। আমারও অবস্থা তেমন ভালো নয়। আমার একটি দোকানঘর ছিল, থাকার জন্য সেটা তাঁদের দিয়েছি। সেখানে রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট হয়। মাঝে মধ্যে রান্না করে একটু তরকারি পাঠাই। এর বেশি কিছু করতে পারি না।'
ওই দোকানঘরেই ৪-৫ বছর ধরে থাকেন তাঁরা। শফিকুর বলেন, এখানে থাকতে তাঁদের অনেক সমস্যা হয়। বিশেষ করে প্রস্রাব-পায়খানার জায়গা নেই। যেতে হয় আশপাশের মসজিদে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না শফিকুর। যে কারণে চা বিক্রি করতে বেরিয়ে পথও ভুলে যান মাঝে মধ্যেই। বেশ কয়েকবার রাস্তায় পড়ে থাকতে হয় তাঁকে। পথচারীরা অটোরিকশায় তুলে পাঠিয়েছেন। শফিকুর আরও বলেন, জীবনের এই সময়ে আর পেরে উঠছেন না। বসে একটা কাজ করতে পারলেও হতো।
ছেলেকে নিয়ে কোনো আশা নেই জানিয়ে কাঁদতে থাকেন সফুরা। তিনি জানান, অনেক অসুস্থ হলেও কষ্ট করে চা বানিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন। মা-বাবার জন্য কিছু করতে না পেরে অনেকেই কাঁদেন বলে শুনেছেন, এমন কেউ যদি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন! বৃদ্ধ বয়সে আর পারছেন না।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. মনির হোসেন মনা বলেন, অনেক দিন ধরে তাঁরা এই দোকানঘরে থাকেন। অনেক সময় শাটার খুলতে ও লাগাতেও কষ্ট করতে হয় তাঁদের। ভালো একটি স্থায়ী ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি। একই রকম কথা বলেন প্রতিবেশী ফুলমালাও।
বাগমারা বাজারের ব্যবসায়ী মো. রানা বলেন, 'উনারা চা নিয়ে এলে আমরা চা নিই বা না নিই, কিছু টাকা দিয়ে থাকি। তবে বয়স ও সার্বিক দিক দিয়ে ভাবলে এ কাজ করা এখন তাঁদের জন্য জুলুম।' সরকার বা সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত বলেও মন্তব্য করেন।
বাহ্রা ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. শাজাহান মিয়া বলেন, বিষয়টি নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছেন। চেয়ারম্যান তাঁদের আইডি কার্ডও রেখেছেন।
বাহ্রা ইউপির চেয়ারম্যান সাফিল উদ্দিন মিয়া বলেন, 'বিষয়টি খুব অমানবিক। আমি চেষ্টা করব, তাঁদের জন্য সরকারি সুবিধার ব্যবস্থা করতে।'
স্থানীয় চেয়ারম্যান আবেদন করলে তাতে সুপারিশ করবেন বলে জানিয়েছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। ইউএনও মো. মতিউর রহমান বলেন, তাঁদের নাম এলে তিনি সহায়তার চেষ্টা করবেন।