ইউএনও-প্রকৌশলীর মধ্যে কয়েক ঘণ্টার টানটান উত্তেজনা

বরিশালের ম্যাপ। ফাইল ছবি
সুমন চৌধুরী, বরিশাল
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৩ | ১৭:৫০ | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৩ | ০৪:৩৬
বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং উপজেলা প্রকৌশলীর মধ্যে কয়েক ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। চলছে নানা গুঞ্জন। এক পর্যায়ে উপজেলা প্রকৌশলীকে প্রায় দুই ঘণ্টা পুলিশ পাহারায় আটকে রাখা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে তাঁকে দণ্ডিত করার যাবতীয় আয়োজনও করেছিলেন ইউএনও।
পুরো ঘটনাকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করা হলেও জানা গেছে, ৪০ লাখ টাকার কাজ নিয়ে দুই কর্মকর্তার মধ্যে বিরোধ দেখা যায়। অর্থবছর শেষ হলেও কাজ শুরু না হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী ওই টাকা ফেরত পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নেন উপজেলা প্রকৌশলী। কিন্তু তাতে বাদ সাধেন ইউএনও। তিনি নিয়ম ভেঙে নিজের নামে ওই টাকা রাখতে চান। উপজেলা প্রকৌশলী এতে রাজি না হলে ইউএনও নিজের ক্ষমতার অপপ্রয়োগে উদ্যোগী হন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
তবে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে ইউএনও নুসরত ফাতিমা ও উপজেলা প্রকৌশলী শহীদুল ইসলামের মধ্যে ‘ভুল বোঝাবুঝির’ অবসান ঘটে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কী নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি– সে সম্পর্কে মুখ খুলছেন না কেউ।
রোববার বিকেলে ঘটনার সূত্রপাত। রাতে ইউএনওর বাসায় ভোজে প্রকৌশলীর অংশগ্রহণের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে দু’জনের সম্পর্কের সৌহার্দ্য প্রকাশ করা হয়। সোমবার সকালে জেলা প্রশাসক ও এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী বাবুগঞ্জে গিয়ে দু’জনের সঙ্গে এক ঘণ্টার বেশি রূদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।
সমকাল বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছে, ঘটনা মোটেই ছোট কিছু নয়। অর্থবছর শেষ হলেও কাজ শুরু না হওয়ায় এডিপি ও অন্য উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা ফেরত যাওয়া ঠেকাতে কাগজপত্রে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ওই টাকা উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর যৌথ হিসাব নম্বরে রাখার চেষ্টা করা হয়। এ সিদ্ধান্ত ঠেকাতে উপজেলা প্রকৌশলী রোববার উপজেলার সোনালী ব্যাংকে অবস্থান করেন। বিকেলে ইউএনও নুসরত ফাতিমা ও উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী এমদাদুল হক দুলাল কয়েকজন ঠিকাদারকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে যান। প্রকৌশলী তাঁর নামসহ তিনজনের নামে হিসাব নম্বর খোলার দাবি করলে তুমুল হট্টগোল হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক গণমাধ্যমকর্মী সমকালকে জানান, ব্যাংকে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় প্রকৌশলী বারবার ইউএনওকে বলেন, ‘এ টাকা যথাযথভাবে খরচ না হলে সরকারের কাছে আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। মামলা হলেও আসামি হব আমি। তাই টাকার নিরাপত্তার জন্য হিসাব নম্বরে আমাকেও যুক্ত রাখতে হবে।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাবুগঞ্জের একাধিক গণমাধ্যমকর্মী সমকালকে বলেছেন, তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে প্রকৌশলীকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেন ইউএনও। প্রকৌশলীকে ব্যবস্থাপকের কক্ষের মধ্যে আনসার পাহারায় রাখা হয়। পরে বাবুগঞ্জ ও বিমানবন্দর থানা পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য ব্যাংকে যান সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুব্রত চন্দ্র বিশ্বাস।
উপজেলার কয়েকজন সাংবাদিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবরটি ছড়িয়ে পড়লে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখে পড়েন ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যান। প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যাংকের মধ্যে অবস্থান করেন তাঁরা। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আবদুল করীমের মধ্যস্থতায় নমনীয় হন ইউএনও। পরে প্রকৌশলী শহীদুল ইসলামের মুচলেকা রেখে সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, বিষয়টি নিয়ে কয়েক দিন ধরে ইউএনওর সঙ্গে প্রকৌশলীর দূরত্ব চলছিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রহমতপুর ইউপি চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান মিলন। তিনি সমকালকে বলেন, চারটি ইউপিতে ৪০ লাখ টাকার সংস্কারকাজ হয়েছে। শনিবার দুটি বিলে স্বাক্ষর করেন প্রকৌশলী। অপর দুটি বিলে তিনি স্বাক্ষর করেননি। রোববার সকালে তিনি অফিসে গেলেও ইউএনওর সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে প্রকৌশলী ব্যাংকে গিয়ে বসেছিলেন। খবর পেয়ে ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যান ব্যাংকে যান। তখন তাঁদের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী এমদাদুল হকের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আবদুল করীম বলেন, তিনি অন্য কাজে ব্যাংকে গিয়েছিলেন। তখন দেখেন, ইউএনও ও প্রকৌশলীর মধ্যে ঠিকাদারি কাজের বিল সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তিনি দু’জনকে বুঝিয়ে ঘটনাস্থলেই সমাধান করে দেন। তখন দু’জনেই আবেগে চোখের পানি ফেলেছেন। প্রকৌশলীকে কারাদণ্ড দেওয়ার উদ্যোগ প্রসঙ্গে আবদুল করীম বলেন, ‘রাগের মাথায় মানুষ অনেক কিছুই বলেন।’
বিমানবন্দর থানার ওসি হেলাল উদ্দিন জানান, ব্যাংকের মধ্যে ইউএনও ও উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল। তাঁর কাছে পুলিশ চাওয়া হলে তিনি ঘটনাস্থলে ফোর্স পাঠান। পরে তাঁরা ফেরত আসেন।
ইউএনও নুসরত ফাতিমা পুরো বিষয় অস্বীকার করে সমকালকে বলেন, রোববার জুন ক্লোজিং থাকায় সব কর্মকর্তাকে নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছিলেন। ম্যানেজারের কক্ষে বসে উপজেলা প্রকৌশলীকে নিয়ে কাগজপত্রের কিছু ত্রুটি সংশোধন করেছেন। এসব নিয়ে বাইরে গুজব ছড়ানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন সমকালকে বলেন, ইউএনও-প্রকৌশলীর ভুল বোঝাবুঝি রাতেই সমাধান হয়েছে। কী নিয়ে তাঁদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি– এ বিষয়ে কিছু বলতে অস্বীকার করেন জেলা প্রশাসক।