চবির শাটল ট্রেনের ছাদে গাছের ধাক্কা
চোয়াল-পা ভেঙে নিউরো সার্জারিতে ৬ শিক্ষার্থী, আইসিইউতে ৩

চবির শাটল ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থী। ছবি-সমকাল
চবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৬:৫৫ | আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৭:০১
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শাটল ট্রেনের ছাদে হেলে পড়া গাছের ধাক্কায় আহত দুই শিক্ষার্থীসহ তিনজনের অবস্থা গুরুতর। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আহত আরও ৬ জনকে রাখা হয়েছে ওই হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে। তাদের কারও চোয়াল ভেঙে গেছে; ট্রেন থেকে পড়ে ভেঙে গেছে পা।
গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে হাটহাজারী উপজেলার চৌধুরীহাট স্টেশনসংলগ্ন এলাকায় শাটল ট্রেনের ছাদে গাছের ধাক্কা লেগে এ দুর্ঘটনা ঘটে। রাতে অন্ধকার থাকায় কেউই হেলে পড়া গাছ দেখতে পাননি। গাছের ধাক্কায় অনেকে ছাদ থেকে পড়ে যান। এ ঘটনায় মোট ১৭ জন আহত হন। শহরগামী রাত সাড়ে ৮টার শাটলে প্রতিদিন তুলনামূলক বেশি ভিড় থাকে। ভেতরে জায়গা না পেয়ে অনেকেই শাটলের ছাদে ওঠেন।
আহতদের মধ্যে বর্তমানে চমেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৯ জন। এর মধ্যে আইসিইউতে ভর্তি লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী অংসইনু মারমা, চট্টগ্রামের সরকারি মহসিন কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী খলিলুর রহমান ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আমজাদ হোসেন। তিনজনের মধ্যে খলিলের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. রবিউল করিম।
শুক্রবার বিকেলে সরেজমিন দেখা যায়, আইসিইউর ১৭ নম্বর বেডে শুয়ে আছেন অংসইনু। পাশে আছেন তাঁর বোন উমেইনু মারমা ও বড় ভাই। বিকেল সাড়ে ৪টায় একবার চোখ খুললেন অংসইনু। কিন্তু চিনতে পারছেন না নিজের ভাইবোনকে।
অন্যদিকে চমেকের নিউরোসার্জারি বিভাগে ভর্তি থাকা ছয়জন হলেন– বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের তাইজুল ইসলাম ও আবু সাইদ, ইংরেজি বিভাগের মোহাম্মদ সান, নৃবিজ্ঞান বিভাগের রাফসান এবং হাটহাজারী কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী আসলাম ও মোরসেদ। তাদের মধ্যে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের আবু সাইদের চোয়াল ভেঙে গেছে। বারবার কান দিয়ে রক্ত পড়ছে। নিজেই টিস্যু দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করছিলেন। এ ছাড়া পায়ে ফ্র্যাকচার নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন মোহাম্মদ সান। এ ঘটনায় আহত সাতজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ১৭ শিক্ষার্থী আহত হওয়ার ঘটনায় রাতভর বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। রাত ১০টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত চলে এ বিক্ষোভ। এ সময় উপাচার্যের বাসভবনের তিনতলা বিল্ডিংয়ের প্রতিটি কক্ষে ভাঙচুর চালানো হয়। পরিবহন দপ্তরে ২২টি বাস, একটি মোটরসাইকেল ও ১৬টি কার ভাঙচুর করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ভাঙচুর চালানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাব ও জিরো পয়েন্টের পুলিশ বক্সেও।
ভাঙচুরের ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলার প্রস্তুতি চলছে। শুক্রবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান উপাচার্য শিরীণ আখতার।
শিক্ষার্থীদের ভাঙচুরে প্রায় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. নূরুল আজিম সিকদার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের নামে ভাঙচুর করা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক।’
ভাঙচুরের ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উপাচার্যের বাসভবন, পুলিশ বক্স, শিক্ষক ক্লাব ও পরিবহন দপ্তরে যে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে, তা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের ব্যর্থ চেষ্টা ছিল।’
এদিকে চবির সাড়ে ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম শাটল ট্রেন। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থীই আবাসন সুবিধার বাইরে। ফলে চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী অবস্থান করেন শহরে। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ থেকে প্রতিদিন দুটি শাটল ৯ বার যাওয়া-আসা করে। প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী যাওয়া-আসা করেন প্রতিদিন। শাটলের বগিতে জায়গা না হওয়ায় প্রায়ই ছাদে ভ্রমণ করেন শত শত শিক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার এই ছাদে ভ্রমণ করাই কাল হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষার্থীদের। দুর্ঘটনার পর শাটলের ভোগান্তি নিয়ে রেলওয়ে ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিয়েছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য।
এ ছাড়া দুর্ঘটনার জন্য শাটলের বগি কম থাকা ও যথেষ্ট সূচি না থাকাকে দায়ী করছেন শিক্ষার্থীরা। শাটলের বগি ও সূচি বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের। বারবার আশ্বাস দিলেও ভোগান্তি লাঘবে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
শাটলের বগি বাড়ানোর বিষয়ে শুক্রবার চমেক হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের অবস্থা দেখতে গিয়ে উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার বলেন, ‘রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে বারবার জানালেও তারা আমাদের এ বিষয়ে সহযোগিতা করছে না।’
শুক্রবার বিকেলে উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে এ দুর্ঘটনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সিন্ডিকেট সদস্য খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘অসংখ্যবার শাটলের বগি বাড়ানোর জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। দুটি বগি বাড়ানোর জন্য টাকা পরিশোধও করা হয়েছে। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দেরি করছে।’
তবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেভাবে বলে, আমরা সেভাবে শাটল ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা করি। তারা যদি চায়, বগি বাড়াতে হবে তাহলে সেই ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে শাটলের সূচিও বাড়ানো হবে।’