এক স্থানে বালুর ইজারা ১০ পয়েন্টে ড্রেজার
যমুনার বুক কেটে বাণিজ্য

প্রতীকী ছবি
লিমন বাসার, উত্তরাঞ্চল
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৪ | ০৭:৩০ | আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৪ | ১০:১৬
আছে এক স্থানে বালু তোলার অনুমতি (ইজারা)। সুযোগ পেয়ে ক্ষমতাধররা খুবলে খাচ্ছে যমুনার ১০ পয়েন্টের বালু। শুধু কী তাই, বগুড়ার সারিয়াকান্দির হাটশেরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইফাজ উদ্দিন বালু তোলার কাজ বেআইনিভাবে ক্ষমতাসীন দলের অন্য নেতাদের কাছে সাব-ইজারাও দিয়েছেন। যমুনার বুক কেটে তুলে আনা বালু রাখা হচ্ছে নদীর বাঁধের পাশে তীর সংরক্ষণ এলাকায়। এ কারণে আসছে বর্ষায় বাঁধ রক্ষা নিয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন অবৈধ পয়েন্টের চারটি বন্ধ ঘোষণা করে লাল পতাকা ঝুলিয়ে দিলেও অভিযোগ আছে, বালু বাণিজ্যে তাল দিচ্ছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও জেলা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
জেলা প্রশাসন থেকে যমুনা নদীর নারামালা পয়েন্টে বালু তোলার ইজারা দেওয়া হয়। তবে সরেজমিন দেখা গেছে, ইজারা স্থানের বাইরে নদীর চন্দনবাইশা, ডাকাতমারা ও কাজলা অংশ থেকেও বালু তোলা হচ্ছে। এ চার পয়েন্টের বালু ড্রেজার দিয়ে তোলার পর স্তূপ করে রাখা হয়েছে চন্দনবাইশা নদী তীরের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে, রৌহদহ, কুতুবপুর এলাকার ধলিরকান্দি, কাজলার ঘাগুয়া ও জামথলে। এ ছাড়া কাজলা থেকে কর্নিবাড়ী পর্যন্ত আরও ছয়টি পয়েন্ট থেকে বালু তুলে তা পাউবোর ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এ বালু পাউবোর ২৪টি প্যাকেজ প্রকল্পের কাজে ব্যবহার হওয়ার খবর মিলেছে। এর পরিমাণ ৫০ লাখ সিএফটি ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। জেলা প্রশাসনের জব্দ তালিকায়ও বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
বালুর খেলায় ক্ষমতাসীনরা
বগুড়া জেলা প্রশাসন গত ২৯ আগস্ট সারিয়াকান্দির বোহাইল ইউনিয়নের নারাপালা মৌজায় একটি বালুমহাল ইজারা দেয়। চুক্তিবদ্ধ হন মেসার্স ফাবিহা ট্রেডার্সের মালিক হাটশেরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইফাজ উদ্দিন। চুক্তি অনুযায়ী তিনি নারাপালা মৌজায় ৩৯.৫ একর জমি থেকে ৬১ লাখ সিএফটি বালু তোলার কথা। এ জন্য সরকারি কোষাগারে ১ কোটি ২২ লাখ টাকা ইজারা মূল্য দেন। অর্থাৎ প্রতি সিএফটি বালু তিনি ১ টাকা ৯৬ পয়সা দরে কেনেন। খরচ যুক্ত হওয়ার পর এ বালু প্রতি সিএফটি ৭ থেকে ৮ টাকায় বিক্রি করা হয়। চুক্তির সময় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ইজারাদার ২০টি শর্ত মানার অঙ্গীকার করেন। এর অন্যতম শর্ত ছিল, নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে অন্য কোথাও বালু তোলা যাবে না। পাশাপাশি বালু নদী তীরের আশপাশে কিংবা সরকারি জায়গায় স্তূপ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। গত ৩ সেপ্টেম্বর বালুমহালের দখল বুঝে নেওয়ার পর নারাপালা মৌজা থেকে বালু তোলা শুরু করেন ইফাজ উদ্দিন। কিছুদিন পরই তিনি শর্ত ভেঙে নিজ দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীর কাছে সাব-ইজারা দেন।
চন্দনবাইশা এলাকায় নদীর তীরসংলগ্ন দুটি স্থানে তুলে রাখা প্রায় দেড় কোটি সিএফটি বালুর সাব-ইজারা দেওয়া হয়। এ কার্যক্রমের সঙ্গে আছেন সারিয়াকান্দি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিক আহমেদ, পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি কুরবান ফকির, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক শাহাদত হোসেন, চন্দনবাইশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন দুলাল। স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী ও ড্রেজার মালিকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শুরু থেকে সেখানে দেড় কোটি সেএফটি বালু ছিল। বিক্রির পর এখনও প্রায় ১ কোটি সিএফটি বালু রয়েছে।
ধলিরকান্দি পয়েন্ট সাব-ইজারা নিয়েছেন কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন শ্যামল ও যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ রনি। এ স্থানে ৪০ লাখ সিএফটি বালু রাখা হয়। বিক্রির পরও সেখানে প্রায় ১৫ লাখ সিএফটি বালু আছে।
রৌহদহ পয়েন্ট সাব-ইজারা নিয়েছেন কামালপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি হেদায়েতুল ইসলাম ও চন্দনবাইশা ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আহম্মেদ। সেখানে ২০ লাখের মধ্যে এখনও ১৫ লাখ সিএফটি বালু আছে।
ঘাগুয়া পয়েন্ট সাব-ইজারা নিয়েছেন কাজলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান মোল্লা। জামথল পয়েন্ট সাব-ইজারা নিয়েছেন কাজলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আব্দুর রশিদ শেখ। এই দুই স্থানে ৩০ লাখ সিএফটি বালুর মধ্যে ২০ লাখ সিএফটি আছে।
প্রশাসনের তৎপরতা
সারিয়াকান্দির যমুনা নদী থেকে তুলে সংরক্ষণ করে রাখা চারটি পয়েন্টের বালু জব্দ করে বগুড়া জেলা প্রশাসন। ইজারার চুক্তির সঙ্গে অসংগতির অভিযোগে সেগুলো জব্দ করা হয়। বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষে রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর রাকিব হাসান চৌধুরী একটি চিঠিতে উল্লেখ করেন, ধলিরকান্দি, চন্দনবাইশা, রৌহদহ ও জামথল পয়েন্টে বালুর স্তূপ রয়েছে। এগুলো ইজারাদার ইফাজ উদ্দিন তাঁর নিজের বালু বলে স্বীকার করলেও বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। রাকিবুর রহমান বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী ইজারাদার হাইড্রোগ্রাফিক জরিপে ৬১ লাখ সিএফটির কিছু বেশি বালু তুলতে পারবেন। তবে এর চেয়ে অনেক বেশি বালু তুলে বিক্রি করা হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু শর্তও ভঙ্গ করা হয়েছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান বলেন, এক মাসেরও বেশি সময় এ বালু জব্দ রয়েছে। তবে এ বালু পরিমাপ করার জন্য একটি দল গঠন করা হলে তারা ৫৭ লাখ সিএফটি বালু রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে। তিনি মনে করেন, অভিযানে জব্দ বালুর পরিমাণ আরও বেশি। মাঠ পর্যায়ে যারা এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা এ ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।
বগুড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, ‘আমরা সার্ভে করে প্রতিবেদন জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছি। এখন তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে পাউবোর কোনো কর্মকর্তা টাকা নিয়ে ভুল প্রতিবেদন দেন না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, নদী থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ বালু তোলার একটি অভিযোগ আসে। এর পর সরেজমিন তদন্ত করে একাধিক পয়েন্টে বালু তোলার প্রমাণ মেলে। এখন বৈধ ইজারাদার কীভাবে এত পয়েন্ট থেকে বালু তুললেন এবং সেগুলোর পরিমাণ ঠিক কত হবে, সে জন্য আলাদা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আলোচনা করে পরে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।
টাকার অঙ্কে মাপজোখ
অভিযোগ রয়েছে, সারিয়াকান্দিতে যে কোনো সময় বালু জব্দ হলেই মাপজোখের সময় টাকার খেলা শুরু হয়। পরিমাপ করার বিষয়টি যারা দেখভাল করেন, তাদের ম্যানেজ করে ফেলে বালুখেকোরা। এ কারণে তাদের ইচ্ছামতো বালুর পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়। সর্বশেষ জেলা প্রশাসন চার স্থানে বালু জব্দ করলেও একই ধরনের খেলা শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ প্রথমে পাউবোর প্রকৌশলী আবদুল মালেকের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তিনি বালু কম করে দেখানোর কারণে সেই কমিটি বাতিল করে প্রশাসন। এর পর জেলা প্রশাসনের কানুনগো শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে এলজিইডির এক প্রকৌশলীকেও রাখা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এবারও টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা হয়। এ কারণে বালুর পরিমাণ তিন গুণ কমিয়ে দেখানো হয় ৫৭ লাখ সিএফটি।
ঝুঁকিতে নদী তীরবর্তী বাঁধ
যমুনা নদীর ভাঙন থেকে সারিয়াকান্দিকে রক্ষায় কামালপুর ইউনিয়নের রৌহদহ থেকে কুতুবপুর ইউনিয়নের শেষ সীমানা পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার নদী শাসন করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ২০১৯ সালে পাউবো এই বাঁধ নির্মাণ শেষ করে। এতে ৩০৬ কোটি টাকা খরচ হয়। শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বাঁধের পূর্ব পাশে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে চর জেগে ওঠে। আর এই চরে ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হয়। এর পর শর্ত ভেঙে নদী তীর ঘেঁষে সেগুলো স্তূপ করে রাখা হয়। এ কারণে অতিরিক্ত বালুর চাপে বাঁধ দেবে যাওয়াসহ আসছে বন্যায় বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা করছেন নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ।
কী বলছেন ইজারাদার
এ ব্যাপারে ইজারাদার হাটশেরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইফাজ উদ্দিন বলেন, যমুনা নদীর যেখানে ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে বাল্কহেড দিয়ে বালু মূল পয়েন্টে আনা হয়। আমি বিভিন্ন এলাকার জমি লিজ নিয়ে বালু রাখছি। তবু সরকারি জায়গায় বালু রাখার মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে। পাঁচ মাসে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ বালু বিক্রি করেছেন– জানতে চাইলে তিনি সঠিক তথ্য দেননি। উল্টো দাবি করেন, এখনও বিভিন্ন স্থানে জরিপ তথ্য অনুসারে যে ৫৭ লাখ সিএফটি বালু রয়েছে, তা বৈধ। জেলা প্রশাসন তাঁর বালু অহেতুক জব্দ করে রেখেছে। আর সাব-ইজারা প্রসঙ্গে বলেন, কোথাও কাউকে ইজারা দিইনি। ব্যবসায়িক স্বার্থে আমার নিকটাত্মীয়দের কাছে থেকে টাকা ধার নিয়েছি। এটাকেই সাব-ইজারা বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
- বিষয় :
- বগুড়া
- বালু উত্তোলন
- ইজারা
- যমুনা নদী