ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

অধিকাংশ ঘরে ঝুলছে তালা

অধিকাংশ ঘরে ঝুলছে তালা

বরাদ্দ নিয়েও কেউ থাকেন না। অধিকাংশ ঘরই পড়ে আছে তালাবদ্ধ অবস্থায় সমকাল

স্বপন চৌধুরী, রংপুর ও মোন্নাফ আলী  উলিপুর (কুড়িগ্রাম)

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:২০

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বিভিন্ন জেলায় ভূমিহীন ও উদ্বাস্তু মানুষের জন্য যেসব আশ্রয়ণ প্রকল্প চালু হয়েছে, তার মধ্যে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ধরনীবাড়ি ইউনিয়নের মুন্সিবাড়ি প্রকল্প অন্যতম। তবে এরই মধ্যে এই প্রকল্পে ঘর বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত গৃহহীনদের ঘর বরাদ্দ না দিয়ে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা অর্থের বিনিময়ে তা বিক্রি করে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

২০২০-২১, ২০২১-২২ অর্থবছরে দুই দফায় আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় মুন্সিবাড়ি প্রকল্পে ১২০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি ঘর তৈরিতে ব্যয় হয় ২ লাখ টাকা। প্রতিটি ঘরে রয়েছে দুটি কক্ষ, একটি রান্নাঘর ও একটি শৌচাগার। রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা। নির্মাণের পর ২ শতক জমিসহ ঘরগুলো সুবিধাভোগীদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তবে এখন ১২০টি ঘরের মধ্যে ৪৪টিতে কেউ থাকেন না। আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বরাদ্দ নিয়ে অধিকাংশ ঘর মালিক সেখানে থাকেন না। তালা দিয়ে শুধু ঘর দখলে রেখেছেন। কেউ ঘর বিক্রি করেছেন, কেউ দিয়েছেন ভাড়া। সরকারি বন্দোবস্ত শর্ত ভঙ্গ করে ঘরে না থাকার কারণ দর্শাতে ২০২২ সালে উলিপুর ইউএনও কার্যালয় থেকে ২৪ নম্বর ঘরের আমিনুল ইসলামসহ কয়েকজন মালিককে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে পরে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। 
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিকাংশ ঘরে তালা ঝুলছে, কেউ থাকেন না। ফলে ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে কিছু ফাঁকা ঘর। অনেক ঘরের বারান্দা ও আশপাশে জমে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা। বকেয়া বিলের জন্য এসব ঘরের বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

আশ্রয়ণের বাসিন্দা মেনেকা রানী, ছকিনা বেগমসহ অনেকে জানান, বরাদ্দ পাওয়া বদিউজ্জামানের ৪৬ নম্বর ঘর, আবদুল মালেকের ৪৫ নম্বর ঘর, উমর আলীর ৫৩ নম্বর ঘর, চাকরিজীবী শিমুল মেহেদীর ২৪ নম্বর ঘরসহ অন্তত ৮টি ঘর বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ৪৯ নম্বর ঘরে থাকেন পঙ্গু সুমন মিয়া। তিনি বলেন, ‘এখানে বেশির ভাগ ঘরে লোকজন থাকেন না। জনৈক আবদুস ছাত্তার আমাদের এখানে থাকতে দিয়েছে। আমাদের জমি, ঘরবাড়ি নেই। তাই অন্যের ঘরে আশ্রিত হয়ে এখানে থাকি। আমার নিজের নামে বরাদ্দের কোনো কাগজ নেই। যে কোনো সময় ঘরের মালিক বের করে দিলে তখন পরিবার নিয়ে রাস্তায় থাকতে হবে।’ ঘরটির মালিক মোহাম্মদ আলীর ঠিকানা ও ফোন নম্বর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সুমন মিয়ার মতো প্রায় একই কথা বলেন আমিনা বেগম, রনজিনা বেগম, বাছিরন বেওয়াসহ অন্তত ১৫ বাসিন্দা।
২৪ নম্বর ঘরটিতে থাকেন মোর্শেদা বেগম। তিনি জানান, এ ঘরটি বরাদ্দ পেয়েছেন আমিনুল ইসলাম। এতদিন তিনি তালা দিয়ে ঘরটি দখলে রেখেছিলেন। ওই ঘরের তালা ভেঙে ইউপি চেয়ারম্যান এরশাদ আলী ও ইউপি সদস্য মতিয়ার রহমান আমাকে থাকতে দিয়েছেন।

অন্যদিকে ধরনীবাড়ি ইউনিয়নের আবদুল হাকিম গ্রামের মো. বদিউজ্জামান ৪৬ নম্বর ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। মারুফ হোসেন নামে একজন তাঁর কাছ থেকে ঘরটি কিনে নিয়ে সেখানে বসবাস করছেন। এ ব্যাপারে জানতে বদিউজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন। ৪৫ নম্বর ঘর বরাদ্দ পান আবদুল মালেক। তিনি ঘর বিক্রি করেছেন জোছনা বেগমের কাছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঘরে থাকা জোছনা বেগমের মেয়ে গোলাপী বেগম। ৫৩ নম্বর ঘর বরাদ্দ নিয়ে তেলিপাড়া গ্রামের উমর আলী তালা দিয়ে দখলে রেখেছেন। তবে উমর আলীর স্ত্রী আলেকজান বেওয়া অভিযোগ করেন, তাদের বরাদ্দের ঘর ইউপি সদস্য মতিয়ার রহমানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউপি সদস্য মতিয়ার রহমান বলেন, ‘উমর আলীর একাধিক বাড়ি রয়েছে। তা ছাড়া ঘরে থাকেন না। ঘরটি বিক্রি নয়, গৃহহীন এশোয়ারাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে।’ তবে অনেকে ঘর বিক্রি করেছেন বলে স্বীকারে করেন তিনি।

ধরনীবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান এরশাদ আলী বলেন, ‘মুন্সিবাড়ি আশ্রয়ণে ঘর বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। বরাদ্দ নিয়ে ঘরে না থাকায় আমি নিজেও অন্তত ২৫ জনের বরাদ্দ বাতিল করে প্রকৃত গৃহহীনদের দেওয়ার জন্য ইউএনওকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’
বিষয়টি নিয়ে উলিপুর ইউএনও (ভারপ্রাপ্ত) কাজী মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্নভাবে শুনেছি, কেউ কেউ বরাদ্দ নিয়েও আশ্রয়ণের ঘরে থাকেন না। তবে ঘর বিক্রি করেছেন এমন খবর জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 
 

আরও পড়ুন

×