ধানের দামে খরচ তোলা দায়

ফুলবাড়ীর ভিমলপুর ইজতেমা মাঠে শুক্রবার ধান মাড়াই শেষে বিক্রির জন্য বস্তায় ভরছেন শ্রমিকরা সমকাল
আজিজুল হক সরকার, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর)
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪ | ২৩:৪২
ধানের ফলন ভালো হয়েছে। অনেক কষ্টে কাটাও শেষের দিকে। হাতে টাকা-পয়সা না থাকায় কাটার পরই বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে দেখেন প্রতি মণের দাম ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা। এভাবে দাম কম হলে আমরা কোথায় যাব। কথাগুলো বলছিলেন ফুলবাড়ীর বারইপাড়া গ্রামের কৃষক মকছেদ আলী। সরকার এবার বোরো ধান ও চালের দাম ৩২ ও ৪৪ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ২৭ টাকায়। এতে খরচও ওঠাতে পারছেন না মকছেদের মতো অনেক কৃষক।
ফুলবাড়ীর সূর্যপাড়া গ্রামের দুই ভাই ছুপল মর্মু ও মনতাজ মর্মু। তাদের জমি না থাকায় ৪ একর বর্গা নিয়ে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন। রোপণ, হালচাষ, সার, সেচ, কাটা ও মালিককে চুক্তির ধান দেওয়াসহ প্রতি একরে তাদের খরচ হয়েছে ৪৬ থেকে ৪৮ হাজার টাকা। আর প্রতি একরে গড়ে ফলন হয়েছে ৭০ মণের মতো।
এবার তীব্র শীতের মধ্যে চারা রোপণ করতে হয়েছে কৃষকদের। পরে তীব্র গরম ও খরায় পুড়ে পরিচর্যা করতে হয়েছে। এর পরও দুই কৃষক স্বপ্ন বুনেছিলেন, ধানের ভালো দাম পেলে বর্ষায় ভালোভাবে থাকতে ইটের ঘর করবেন। তাতে অন্তত ঘুমানোর ঝামেলা থাকবে না। এবার হাতে টাকা-পয়সা না থাকায় কাটার পরই ধান বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তারা। তবে বাজারে দাম কম থাকায় ছুপল মর্মু ও মনতাজ মর্মুর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
দুই ভাই বলছিলেন, এক বিঘায় আবাদে চাষে ১ হাজার ৮০০ টাকা, সার ৬ হাজার, রোপণে ২ হাজার, নিড়ানোর শ্রমিকের ৪ হাজার, কীটনাশকে ৩ হাজার, কাটতে ৩ হাজার, মাড়াই করতে ১ হাজার ও সেচের জন্য ২ হাজার টাকা লেগেছে। বস্তা ও ভ্যানে হাটে নিয়ে যাওয়াসহ বিঘায় খরচ হয়েছে ২৩ থেকে ২৪ হাজার টাকা। বিঘায় ফলন হয়েছে ৩৫ থেকে ৩৬ মণ। সেই হিসাবে ধানের দাম আসছে ৩২ হাজার ৪০০ টাকা। বর্গা বাবদ বিঘাপ্রতি মালিককে ১০ মণ ধান দিতে হয়। এর দামও ৯ হাজার টাকার বেশি। ঘাটতি থাকছে ৬০০ টাকা।
কৃষকরা জানান, যাদের নিজেদের জমি আছে, তাদের হয়তো প্রতি বিঘায় কয়েক হাজার টাকা থাকবে। এর পরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সবার সর্বনাশ হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে কৃষক এখন ধানের উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় হতাশ। ভর্তুকি মূল্যের কম্বাইন হার্ভেস্টারে ধান কাটতেও একরে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। স্থানীয় মেলাবাড়ী গ্রামের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমানও আবাদে যুক্ত। তাঁর ভাষ্য, এবার ব্যাংকগুলো ঋণ না দেওয়ায় বাজারে ধানের দাম কম। ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা না থাকায় তারা ব্যবসা করতে পারছেন না।
উপজেলার একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাও ঋণ না দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এদিকে উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে ফুলবাড়ী উপজেলায় ১৪ হাজার ২১০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এসব ক্ষেতের ধান কাটতে শতাধিক কম্বাইন হার্ভেস্টার যন্ত্র চালু রয়েছে। ধানের দাম সরকারিভাবে ৩২ টাকা কেজি নির্ধারণ করা আছে।
স্থানীয় প্রাণবঙ্গ মিলার্স গত বছরের ১০ এপ্রিল থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৭৮ কেজি বস্তার চিকন জাতের ধান ২ হাজার ৪৫০ টাকা এবং বিআর ২৮ কিনেছে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। এখন কিনছে চিকন জাত ২ হাজার এবং ২৮ জাত ১ হাজার ৯৫০ টাকা বস্তা। প্রাণবঙ্গ মিলার্সের জিএম জাকারিয়া হোসেন বলেন, গত বছর ধানের দাম ভালো ছিল। এবার অনেকটাই কম।
আমিন অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী রুহুল আমিনের ভাষ্য, বোরো মৌসুমের শুরুতে চিকন জাতের ধান ২৩ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা বস্তা ছিল। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ দাম পড়ে যায়। এ বিষয়ে পৌরসভার পশ্চিম গৌরীপাড়ার হাসান আলী মিয়া বলেন, অনেক কষ্টে তিন একর জমিতে ধানের আবাদ করেছিলেন। কিন্তু কাটতে প্রতি বিঘায় ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৯৩০ থেকে ৯৫০ টাকায়। খরচ বাদে তেমন কিছু থাকে না।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মঈন উদ্দিন বলেন, গত ১৫ মে বোরো ধান ৩২ টাকা কেজি কেনার উদ্বোধন করা হয়েছে। এর আগে থেকে নেওয়ার সুযোগ নেই। আগে থেকে নেওয়া গেলে হয়তো বাজারে তার প্রভাবে দাম বাড়ত। এতে কৃষক উপকৃত হতেন।
উপজেলায় অর্ধেক ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে কৃষি কর্মকর্তা রুম্মান আক্তার বলেন, ধান ৮০ ভাগ পাকলে কাটার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। দামও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে বিক্রি করলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন। তাদের সুবিধার জন্য সরকার ভর্তুকি দিয়ে উপজেলায় শতাধিক কম্বাইন হার্ভেস্টার যন্ত্র চালু করেছে।
জাতীয় পর্যায়ে ধান কেনা আগেই শুরু হয়েছে জানিয়ে দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সারাদেশে তো একসঙ্গে ধান পাকে না। সরকারিভাবে কেনার সঙ্গে দামের কতটুকু সম্পর্ক আছে, তা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলতে পারবে। সরকার তো সব ধান কিনতে পারে না।
- বিষয় :
- বোরো