ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ছয় হাজার পরিবারকে মৃত্যুকূপে ফেলল কারা

ছয় হাজার পরিবারকে মৃত্যুকূপে ফেলল কারা

চট্টগ্রামের ২৬ পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি পরিবার। লালখান বাজারের মতিঝর্ণা পাহাড়ের চিত্র। ছবি: মো. রাশেদ

 শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম 

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৪ | ০০:১৭ | আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪ | ১৪:৩৯

টানা বৃষ্টি ও বর্ষা এলেই পাহাড় ধসের আশঙ্কা বেড়ে যায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। ঘুম ভাঙে প্রশাসনের, নড়াচড়া শুরু করেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। লোক দেখানো কয়েকটি অভিযানও পরিচালনা করেন তারা। সেই অভিযানে হাতেগোনা কয়েকটি পরিবারকে করা হয় উচ্ছেদ। নির্দেশ জারি হয় অবৈধভাবে দেওয়া বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার। তবে প্রতিবারই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাকার সুযোগ করে দেওয়া ‘পাহাড়খেকোরা’

এই তালিকায় আছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদসহ আরও অনেক প্রভাবশালীর নাম। এ কারণে তাদের ব্যাপারে কখনোই মুখ খোলে না প্রশাসন। পরিবেশবাদীসহ বিভিন্ন সংগঠনের চাপে কয়েকবার পাহাড়খেকোদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিলেও রহস্যজনকভাবে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে গত কয়েক দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি ও ঝোড়ো বাতাস বয়ে যাওয়ায় বাড়ছে পাহাড় ধসের আশঙ্কা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ভীতি। আগের অভিজ্ঞতা মনে করে উদ্বিগ্ন সচেতন মহল। বড় দুর্ঘটনা এড়াতে দাবি করা হচ্ছে জরুরি পদক্ষেপ।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, নগরীতে ২৬টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে। এসব পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি পরিবার বসবাস করছে। যেখানে শিশু, বৃদ্ধসহ বসবাসরত মানুষের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। অবৈধভাবে বসবাস করলেও এখানে রয়েছে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার পানির সংযোগও। শুধু অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগই আছে পাঁচ সহস্রাধিক। এতে প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা বিব্রত হলেও নেননি উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ।

নগরীর চন্দ্রনগর এলাকায় গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকার পাশের ১৬ একরের পাহাড়ের শূন্য দশমিক ৭ একর জমি গিলে ফেলেছে পাহাড়খেকোরা। যার সত্যতাও পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাহাড়টি মিলেমিশে হজম করেছে অন্তত ২০ জন। তাদের মধ্যে মনির হোসেন, মোহাম্মদ ইমতিয়াজুর রহমান, শামসুন নাহার, মহিন উদ্দীন, শামসুদ্দীন বাদল, বদরুল আলম, বাহার উদ্দিন, আফরোজা বেগম, রতন মিয়া, মো. খালেদ, রিনা আক্তার, মো. ইলিয়াছ, জহির উদ্দীন, মো. লোকমান, মোহাম্মদ শামীম, মো. মানিক, মো. সোহেল ও জান্নাতুন নিসা উল্লেখযোগ্য। তারা সবাই বায়েজিদ বোস্তামী থানার চন্দ্রনগরের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে বাহার উদ্দিন ২০১৮ সালের বায়েজিদ থানার ১০ নম্বর পাহাড় কাটা মামলার আসামি। শামসুদ্দীন বাদলের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে পাহাড় কাটার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। একই ঘটনায় বাহার উদ্দিনও জড়িত। তারা ১২ লাখ টাকা জরিমানাও দেন। তবে দিনশেষে তারা কেউই পাহাড় সাবাড় করা থেকে বিরত হননি।
অভিযুক্ত জহির উদ্দীন বলেন, ‘আমি কোনো পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত নই। কেউ অভিযোগ করে থাকলে তা ভিত্তিহীন।’ এটুকু বলেই মোবাইল ফোনের লাইনটি কেটে দেন তিনি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের বিরুদ্ধে পাহাড় দখল করে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগের একাধিকবার প্রমাণ পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। গত ২৬ জানুয়ারি তাঁর পাহাড় কাটা ও স্থাপনা নির্মাণকাজ পরিদর্শনে গিয়ে হামলার শিকার হন পরিবেশবিদরা। এই জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে পাহাড় সাবাড় করার অভিযোগে একাধিক মামলা বিচারাধীন থাকলেও তাকে পাহাড়খেকো বলতে নারাজ প্রশাসন। 

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘পাহাড়গুলো দেখভালের দায়িত্বে আছে কয়েকটি সরকারি সংস্থা। তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ায় মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও সাফল্য আসে না। কিছুদিন পর আবারও নতুন বসতি ও স্থাপনা তৈরি হয়।

বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ে অবৈধ ৫ হাজারের বেশি বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। এগুলো বিচ্ছিন্ন করে জড়িতদের বিষয়ে তথ্য দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে পাহাড়খেকোদের চিহ্নিত করাসহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্য চেয়ে কয়েক বছর ধরে সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) সরকারি সংস্থাকে চিঠি দিয়ে আসছে জেলা প্রশাসন। চিঠিতে সংযুক্ত নির্দিষ্ট ফর্মের শেষ ঘরে পাহাড়ে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া ব্যক্তিদের নাম ও ঠিকানা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে কোনোবারই চিঠির জবাবের ক্ষেত্রে চারটি ঘরে যথাক্রমে– ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের নাম ও মালিকানা, অবৈধভাবে বসবাসকারীর নাম, পরিবারের সদস্য সংখ্যা এবং অবৈধ স্থাপনার বিবরণ উল্লেখ করলেও পূরণ করা হয় না শেষ ঘরটি। 
সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, সরকারি সংস্থাগুলো জানে কারা পাহাড়খেকো। এর পরও অভিযুক্তদের চিহ্নিত করছে না।  

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কারা পাহাড়খেকো সেটা না জানাটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এসব অন্যায়-অনিয়মের সঙ্গে প্রশাসন জড়িত বলেই অভিযুক্তরা চিহ্নিত হয় না। প্রশাসন লোক দেখানো কাজে ব্যস্ত থাকছে। স্থানীয় কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম একের পর এক পাহাড় সাবাড় করলেও প্রশাসন নীরব। এটা ফৌজদারি অপরাধ।’

আরও পড়ুন

×