১৫৬ একর বনভূমি ৭ লাখে বন্দোবস্ত

.
ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার
প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৪ | ০১:১৪
কক্সবাজারের রামুতে ১৫৬ একর বনভূমি মাত্র ৭ লাখ টাকায় দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দিয়েছে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৬ সালে শহীদ এটিএম জাফর আলম মাল্টিডিসিপ্লিন একাডেমির নামে এ জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব শফিউল আলম তাঁর ভাইয়ের নামে করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব ছিলেন। তবে এ জমিকে বনভূমি দাবি করে বন্দোবস্ত বাতিল করতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে চিঠি দেওয়ার পরও এ বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়নি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্র জানায়, শহীদ এটিএম জাফর আলম ক্যাডেট কলেজের নামে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রদানের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে বলা হয়েছে, রামু উপজেলার খুনিয়াপালং মৌজার এক নং খাস খতিয়ানভুক্ত ১৪৯৪ দাগের ১৫৫ দশমিক ৭০ একর জমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জমির ৭৭ লাখ ৭ হাজার ১৫০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করে ৭ লাখ ৭০ হাজার ৭১৫ টাকা মূল্যে এ জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরে শহীদ এটিএম জাফর আলম ক্যাডেট কলেজের নাম পরিবর্তন করে শহীদ এটিএম জাফর আলম মাল্টিডিসিপ্লিন একাডেমি নাম দেওয়া হয়।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, বন বিভাগ এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার চিঠি দেওয়ার পরও এ বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়নি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। এ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এএসএম ফেরদৌস স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে বলা হয়েছে, জমিটি গেজেটভুক্ত রক্ষিত বন। তাই এ বনকে খাস জমি হিসেবে বন্দোবস্তযোগ্য নয় বিধায় কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বন্দোবস্ত দেওয়া যায় না। এ বনভূমিতে সরকারি ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে সৃজিত বিভিন্ন বন, প্রাকৃতিক গাছপালা ও ঝোপ-জঙ্গল বিদ্যমান রয়েছে। একই সঙ্গে এ বন বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। তাই সব কিছু মিলিয়ে রক্ষিত এ বন বনায়ন ব্যতীত ভিন্ন কাজের উদ্দেশ্যে জেলা প্রশাসক কক্সবাজার কর্তৃক দেওয়া বন্দোবস্ত বাতিলযোগ্য।
বন বিভাগের অভিযোগ, এ জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার পরপরই কয়েক লাখ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, বিষয়টি আমি যোগদানের আগে, তাই ফাইল দেখে বলতে হবে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, শফিউল আলম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এ জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। তাই ওই সময়ে এর বিরোধিতা করার কোনো সুযোগ ছিল না প্রশাসনের।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা সরওয়ার আলম সমকালকে বলেন, এ বন্দোবস্তের বিরোধিতা করে ওই সময় আপত্তি জানিয়ে বন বিভাগের পক্ষ থেকে চিঠিও দিয়েছিলাম; কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনেনি।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, এমনিতেই কক্সবাজারে বনভূমি দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে বিশেষ একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ১৫৬ একর জমি বন্দোবস্ত দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।
কক্সবাজারের বনভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। তাদের তথ্যমতে, কক্সবাজার জেলায় মোট বনভূমির পরিমাণ ২ লাখ ৬০ হাজার ৪৬ একর, যার মধ্যে অবৈধ দখলে গেছে ৪৫ হাজার ৯৯০ একর। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য ৬ হাজার ১৬৪ একর বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আরও ১৪ হাজার ৩৭২ একর। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের মোট বনভূমির এক-তৃতীয়াংশ ইতোমধ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বেদখল হয়ে গেছে।
সেইভ দ্য কক্সবাজারের সভাপতি আনছার হোসেন বলেন, দেশের বনভূমি রক্ষায় রয়েছে সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি। রয়েছে আইন, নীতি, আদালতের নির্দেশ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্দোবস্তযোগ্য পতিত জমি ও অকৃষি খাস জমি থাকা সত্ত্বেও কেন বারবার কক্সবাজার জেলার বনভূমিকে উন্নয়নের নামে বনবিরুদ্ধ ব্যবহারের জন্য বেছে নেওয়া হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব শফিউল আলমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেওয়া
সম্ভব হয়নি।
- বিষয় :
- বনভূমি দখল