লাশে আগুন দেয় পুলিশই

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:১০
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে আশুলিয়া থানার সামনে হত্যা করা বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতার লাশে পুলিশই আগুন দিয়েছিল। স্থানীয় সূত্রে একটি ভিডিও পেয়েছে সমকাল। সেখানে দেখা গেছে, লাশ রাখা পিকআপে যখন আগুনের সূত্রপাত হয়, তখন এটির চারদিকে শুধু পুলিশ সদস্যরাই ছিলেন।
গত ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানাসংলগ্ন বাইপাইল এলাকা ঢাকা-চন্দ্রা মহাসড়কে অভ্যুত্থানকারীর ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। সেদিন দুপুর ১২টার পর রাজধানীসহ অন্য এলাকা থেকে সরে গেলেও আশুলিয়ায় বিকেল পর্যন্ত পুলিশ মারমুখী ছিল। আন্দোলনকারীরা দুপুর থেকেই আশুলিয়া থানার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে।
সে সময় পুলিশের কয়েকজন সদস্য আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে অস্ত্র ও হাত ওপরে তোলে। তবে অন্যরা গুলি চালায়। গুলিতে ব্যক্তিদের লাশ একটি রিকশাভ্যানে পুলিশ সদস্যরা স্তূপ করে রাখছে– এমন ভিডিও গত ৩০ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ায়। এএফপির ফ্যাক্ট-চেকিং এডিটর কদরুদ্দীন শিশির তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে ঘটনাটি ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার কাছাকাছি এলাকায় বলে জানান।
এই সূত্র ধরে ৩১ আগস্ট সমকাল প্রতিনিধি ওই এলাকায় যান। স্থানীয় সূত্র থেকে আরও ৫ আগস্টের ১৮টি ভিডিও পায়। এতে নিশ্চিত হয়, আশুলিয়া থানা লাগোয়া ‘ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেড অফিসার ফ্যামিলি কোয়ার্টারের’ পাশের সড়কে ৫ আগস্ট হত্যাযজ্ঞ চালায় পুলিশ। সে সময় প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে জানা গিয়েছিল, পুলিশ মৃত ব্যক্তিদের লাশ ভ্যান থেকে কোনো এক সময় লেগুনা পিকআপে তুলেছিল। বিকেলের দিকে আন্দোলনকারীর ধাওয়ার মুখে টিকতে না পেরে পালানোর সময় লাশভর্তি পিকআপটিতে আগুন দেয় পুলিশ।
গত ৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সূত্র থেকে ১ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের আরেকটি ভিডিও পায় সমকাল। এটি থানা ভবনে পশ্চিমের একটি বহুতল ভবন থেকে ধারণ করা। দূরত্বের কারণে অগ্নিসংযোগকারী এবং পিকআপ ঘিরে রাখা পুলিশ সদস্যদের চেহারা স্পষ্ট নয়। ভিডিওর প্রথম সেকেন্ডে বিস্ফোরণের আলোকচ্ছটা দেখা যায়। এ সময় পাশে থাকা পিকআপের পেছন দিকের আগুনের সূত্রপাত দেখা যায়। পরে আগুনের কুণ্ডলী বড় হতে থাকে।
স্থানীয় এক সাংবাদিক সমকালকে জানিয়েছেন, ভিডিও ধারণকারী তাঁকে নিশ্চিত করেছেন, পিকআপে পুলিশ আগুন দিয়েছে। তা দেখে তিনি ভিডিও করেন। তাই আগুন দেওয়ার মুহূর্তটি ধারণ করতে পারেননি। এর দু-তিন সেকেন্ড পর থেকে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে। ওই সময় পিকআপের চারপাশে পুলিশ ছাড়া কেউ ছিল না। ৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটেছিল।
সমকাল সেদিনের আরও ১৮টি ভিডিও পেয়েছে স্থানীয় সূত্র থেকে। তাতে দেখা গেছে, পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ব্রাজিলের জার্সি পরা এক তরুণের লাশ ভ্যানে তুলছে পুলিশ। আরেকটি ভিডিও থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা যায়, পিকআপে পোড়া দেহগুলোর একজনের গায়ে ব্রাজিলের সেই হলুদ জার্সি পরা। এ দুই ছবি যোগসূত্র প্রমাণ করে, পুলিশই লাশে আগুন দেয়।
এসব ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল থানার ঠিক বিপরীতে রাশেদা সুপারমার্কেটের দ্বিতীয় তলার কক্ষ থেকে। আগের মতো এ বিষয়ে আশুলিয়া থানা পুলিশ মন্তব্য করেনি।
জার্সি পরিচিত লাশটি দিনমজুর আবুল হোসেনের বলে তাঁর স্ত্রী লাকী আক্তার শনাক্ত করেন। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর স্বামী ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। পরে জানতে পারেন, পুলিশের গুলিতে আবু হোসেন নিহত হয়েছেন। তবে লাশ পাননি। পরদিন পোড়া লাশে জার্সি দেখে শনাক্ত করেন।
সেদিন পুলিশের আগুন দেওয়া পিকআপে কতটি লাশ ছিল, তা এখনও নিশ্চিত করে জানা যায়নি। স্থানীয়দের ভাষ্য, ১২ জন নিহত হন থানার সামনে। এর মধ্যে আবদুল মান্নানসহ কয়েকজনের লাশ আন্দোলনকারীরা সে সময়েই উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। বাকিগুলো সড়ক থেকে তুলে বস্তার মতো ভ্যানে ছুড়ে স্তূপ করে পুলিশ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পোড়া চারটি লাশ শনাক্ত করা গেছে। দুটি অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়েছে।
ভ্যান থেকে পিকআপে কয়টি লাশ তোলা হয়েছিল, তা নিশ্চিত করতে পারেননি ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মেদ মুইদ। তিনি সমকালকে বলেন, ছয় থেকে সাতজনের কথা শোনা যাচ্ছে। তদন্ত কমিটি এখনও প্রতিবেদন দিতে পারেনি।
পুলিশই আগুন দিয়েছে– নতুন করে পাওয়া এ ভিডিওর বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ভিডিওটি তদন্ত কমিটিকে দিলে তাদের সহায়তা হবে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। দায়ী হিসেবে কয়েকজনকে চিহ্নিতও করা হয়েছে।
গত ৩১ আগস্ট জানা গিয়েছিল, ভ্যানে লাশ ছুড়ে দিয়ে স্তূপ করা দুই পুলিশ সদস্যের একজন ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন। তিনি পলাতক। দুটি ভিডিওতে লাল গেঞ্জির ওপর পুলিশের ভেস্ট পরা অস্ত্রধারী এক ব্যক্তিকে দেখা গেছে।
- বিষয় :
- আগুনে পুড়িয়ে হত্যা