ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

বন্ধ কোয়ারি খুলতে আবার সোচ্চার ব্যবসায়ী-শ্রমিক

বন্ধ কোয়ারি খুলতে আবার সোচ্চার ব্যবসায়ী-শ্রমিক

ফাইল ছবি

 মুকিত রহমানী, সিলেট ও    জাকির হোসেন, গোয়াইনঘাট

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:২৬

একসময় সিলেটের জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা রাজার অধীনে নির্জন বনভূমি। ১৯৫৪ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর পতিত ছিল জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা। ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন। পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকলে সেখানে গড়ে ওঠে জনবসতি। একইভাবে পাকিস্তান আমলে সীমান্তঘেঁষা সিলেটের বিভিন্ন নদী মোহনায় পাথরের সন্ধান শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইজারা দেওয়া শুরু করে সরকার। আশি ও নব্বইয়ের দশকে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে সিলেটের ‘পাথররাজ্য’। তবে যন্ত্রের ব্যবহার ও নীতিমালা না মেনে পাথর উত্তোলনের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হতে থাকে। এ নিয়ে সোচ্চার হন পরিবেশবাদীরা। যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধসহ একে একে পাথর কোয়ারি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে কোয়ারিগুলো পুনরায় চালুর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।

বিভিন্ন কোয়ারি ৪ থেকে ৯ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীসহ ৬-৭ লাখ শ্রমিক। তাদের মধ্যে রয়েছেন বেলচা, বারকি, লোড-আনলোড, ট্রাক-ট্রাক্টর ও স্টোন ক্রাশার মিল শ্রমিক। এই শ্রমিক, কোয়ারি মালিক ও ব্যবসায়ীরা কয়েক বছর ধরে কোয়ারি চালুর দাবিতে অবরোধ, মিছিল-সমাবেশ ও ধর্মঘট করে আসছেন। কোয়ারি খোলার দাবি নিয়ে কেউ কেউ যান উচ্চ আদালত ও মন্ত্রণালয়ে। ২০২২ সালের নভেম্বরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ নায়েব আলীর নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি পরিদর্শন করে। এরপর তারা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে শর্তসাপেক্ষে পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়া হতে পারে বলে মত দেওয়া হয়। কিন্তু পরে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এদিকে কোয়ারি বন্ধ থাকলেও চুরি করে পাথর উত্তোলন থামেনি। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন এবং পরের দিন জাফলং ও সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে প্রায় ৩০ কোটি টাকার পাথর চুরি করা হয়।
এদিকে সরকার পতনের পর নতুন করে মাঠে নামেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। বিভিন্ন স্থানে মিছিল-সমাবেশ ছাড়াও সম্প্রতি কোম্পানীগঞ্জের পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে গণস্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়। ৩১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সিলেটের পাথর কোয়ারি খোলার দাবি করেন ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম। 
গত রোববার সংবাদ সম্মেলন করে বৃহত্তর সিলেট পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। সমন্বয়ক শাব্বির আহমদ তাঁর বক্তব্যে দাবি করেন, বিগত সরকার ভারত ও সিন্ডিকেটের স্বার্থে পাথর কোয়ারি বন্ধ রেখেছিল। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সিলেটের সব পাথর কোয়ারি বন্ধ করে দিয়ে বিদেশ থেকে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অপচয়ের মাধ্যমে পাথর আমদানি শুরু করে। কোয়ারি বন্ধ করে দেওয়ায় এ অঞ্চলের লাখো মানুষের জীবন-জীবিকায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।
সিলেট পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল জলিল সমকালকে জানান, কোয়ারি খুলে দিলে বিদেশ থেকে পাথর আমদানি কমবে। ডলার সংকট কাটবে। পরিবেশের ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, যন্ত্র ব্যবহার না করে হাত দিয়ে পাথর উত্তোলনে পরিবেশের ক্ষতি হবে না। কোয়ারি বন্ধ থাকায় পাহাড়ি ঢলে অনেক পাথর ও বালু জমাট হয়ে আছে। বৃহত্তর কোয়ারি ভোলাগঞ্জ ৭০০ একর ও জাফলং কোয়ারি ২১৩ একরজুড়ে। এই দুই কোয়ারিতে দুই লক্ষাধিক শ্রমিক ও ব্যবসায়ী যুক্ত ছিলেন। সব মিলিয়ে ৬-৭ লাখ লোক কোয়ারিগুলোতে যুক্ত ছিলেন। তারা বেকার হয়ে গেছেন। শত শত ক্রাশার মিলও বন্ধ। 

তবে পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আখতার সমকালকে বলেন, সিলেটের পরিবেশ রক্ষার জন্য কোয়ারি বন্ধ রাখা জরুরি। পরিবেশ রক্ষা করতে হলে পাথর উত্তোলন করা যাবে না। তিনি বলেন, জাফলংয়ের বিষয়ে এখনও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এটি নিষ্পত্তি না হলে কী করে সরকার অনুমতি দেবে। 
সারী নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ও পরিবেশকর্মী আব্দুল হাই আল হাদি বলেন, পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগেই পাথর কোয়ারিগুলো বন্ধ করা হয়েছিল। অনেক মানুষের রুটিরুজির বিষয় থাকায় হাতে তোলা যাবে এমন শর্তে কোয়ারি খুলে দেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ ও কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।  
২০১৪ সালে বেলার দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোয় যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন উচ্চ আদালত। তবে অপরিকল্পিতভাবে ও যন্ত্রের সাহায্যে পাথর তোলা অব্যাহত থাকায় ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দি ও লোভছড়া কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১৪ সালে যন্ত্রের ব্যবহারে ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করেন আদালত। 
বৃহত্তর পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-মালিক সমিতির সহকারী সদস্য সচিব সাব্বির আহমদ ফয়েজ জানান, শুধু পাথর শ্রমিক নন, কোয়ারিতে পরিবহন শ্রমিক পরোক্ষভাবে যুক্ত। সে জন্য তারাও আন্দোলন করেছেন। শিগগির তারা দাবি নিয়ে সরকারের কাছে যাবেন। জাফলং-বল্লাঘাট পাথর উত্তোলন বহুমুখী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি সিরাজ মিয়া জানান, বছরের পর বছর শ্রমিকরা বেকার। এখন সময় এসেছে তাদের রক্ষা করার। 

প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবেদন
জাফলং চুনাপাথর কোয়ারি নিয়ে উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে গত ১ সেপ্টেম্বর আবেদন করেন জালালাবাদ লাইম ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশনের ব্যবস্থাপনা অংশীদার আফছার উদ্দিন। তিনি এতে উল্লেখ করেন, ১৯৭২ সালে সরকার চুনাপাথর প্রকল্পের জন্য জাফলং এলাকায় ৭৮.২৭ একর জায়গা ইজারা দেয়। খনিজ দ্রব্য উত্তোলনও করা হয়। পরে প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে বাধা সৃষ্টি ও ইজারা বাতিল করে। ২০০৭ সালে উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চুনাপাথর উত্তোলনে বাধা না দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০২০ সালে আরেকটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ইজারা বাতিলের চিঠি অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর পরও তারা সহযোগিতা করেনি। উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন ও সেই সময়ে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান আফছার উদ্দিন।
 

আরও পড়ুন

×