রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় উন্নয়ন বঞ্চনায় বগুড়া

ফাইল ছবি
লিমন বাসার, উত্তরাঞ্চল
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০৮:১৪
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে বগুড়াবাসীর বড় দাবির কোনোটিই পূরণ হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এ জেলার উন্নয়ন নিয়ে চলেছে বৈষম্য। এখন পট পরিবর্তনে বঞ্চিত বগুড়াবাসী আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছেন। তারা মনে করছেন, উত্তরের রাজধানীখ্যাত বগুড়ায় দীর্ঘ সময় পর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে।
বগুড়ায় রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর। আরও আছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এ ছাড়া দ্বিতীয় বিসিক শিল্পনগরীর জন্য নির্ধারিত স্থান ছাড়াও সিরাজগঞ্জ-বগুড়া রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কার্যক্রমের নথি মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে বছরের পর বছর। একইভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পের বিষয়ও রয়েছে অনুমোদনের অপেক্ষায়। শুরু থেকেই এসব প্রকল্প নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ছিল উদাসীন। নানা প্রতিবন্ধকতার অজুহাতে দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে ফাইলবন্দি করে রাখা হয়।
উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর দুই বিভাগের মধ্যে বগুড়ায় দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য বলছে, দেশে দারিদ্র্যের হার ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ হলেও বগুড়ায় এ হার মাত্র ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। বগুড়ায় বিশেষত কৃষি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশ তৈরির অনেক কারখানা রয়েছে। সাবান কারখানার জন্য আছে বগুড়ার খ্যাতি। রবিশস্য উৎপাদনের জন্যও এ জেলার মাটি খুবই উপযোগী। এ রকম ইতিবাচক অনেক অনুষঙ্গ থাকলেও বগুড়ায় হয়নি উন্নয়ন।
জেলাবাসীর অন্যতম দাবি সিটি করপোরেশন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের শাসনামলে সিটি করপোরেশনের লক্ষ্যে বগুড়া পৌরসভার আয়তন বাড়ানো হয়। এখন ২১ ওয়ার্ড নিয়ে ৬৯ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটার এলাকার বিশাল একটি পৌরসভা রয়েছে এখানে। এত বড় এলাকা সামাল দিতে পৌরসভার সীমিত বাজেটে হিমশিম খেতে হয়। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে শহরবাসী বঞ্চিত হচ্ছে। বিগত সরকার রংপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করে। কিন্তু বগুড়াকে আমলেই নেওয়া হয়নি। অথচ সিটি করপোরেশনে উন্নীতকরণের শর্ত অনেক আগেই পূরণ করে বগুড়া। শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে বগুড়া সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন হয়নি বলে মনে করে স্থানীয় নাগরিক সমাজ।
বগুড়া বিমানবন্দর চালুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে। এটি চালুর পক্ষে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) প্রতিবেদনও দেয়। তবে বিমানবন্দর চালুর ‘সবুজ সংকেত’ বন্দি হয়ে আছে লাল ফাইলে। এটি চালু হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা– এমনটিই বলছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। এ দুই জেলার মধ্যে সরাসরি রেলপথ না থাকায় উত্তরাঞ্চলের ট্রেনগুলোকে যাত্রী ও কৃষিপণ্য নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বগুড়া থেকে তিন জেলার সীমানা পেরিয়ে প্রায় ৪০৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে সময় লাগে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। আর সড়কপথে ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাসে করে ঢাকা যেতে সময় লাগে ৬ ঘণ্টা। অথচ বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুতে সরাসরি ট্রেনযোগে পৌঁছতে সময়ে লাগবে এক থেকে সোয়া ঘণ্টা। বগুড়া থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন সার্ভিস চালু হলে বগুড়াসহ উত্তরের জেলার ট্রেনযাত্রীদের প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ কমে আসবে। নানা জটিলতায় এ প্রকল্পের কাজ এখনও শুরুই করা যায়নি।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। স্থান নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বগুড়ার শাজাহানপুরের ২৫১ একর জায়গা নির্ধারণ করে। সেখানেই অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার কথা। উদ্দেশ্য শিল্পনগরীখ্যাত বগুড়ার হারানো গৌরব ফেরানো। তবে দীর্ঘ সময়েও এ কাজের অনুমতি মেলেনি।
১৬ বছর ধরে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করা হয়নি। অথচ স্টেডিয়ামটি উত্তরাঞ্চলের গর্ব। মুশফিকুর রহিম, শরিফুল ইসলাম, অনূর্ধ্ব ১৯ দলের তামিম, তৌহিদ হৃদয়, খাদিজাতুল কোবরা, শারমিন সুলতানা, ঋতু মনিসহ আরও অনেক ক্রিকেটার তৈরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে এ মাঠ।
শহরের ফুলদীঘিতে বাংলাদেশ টেলিভিশন বগুড়া আঞ্চলিক কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও পরবর্তী সময়ে সেই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন এ জনপদে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন শিক্ষাবিদরা।
বগুড়ার বড় প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয় ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে। পাইপলাইনে গ্যাস সঞ্চালন, শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম পুনর্নির্মাণ, বনানী থেকে মাটিডালী পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ, সাতমাথা থেকে তিনমাথা পর্যন্ত রাস্তা প্রশস্তকরণ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ, বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্রিসেন্ট ব্রিজ, এসপি বিজ্রের মতো অনেক প্রকল্প ছিল এ তালিকায়। পরবর্তী সময়ে বগুড়ার উন্নয়নে স্থবিরতা নেমে আসে। এমনকি জেলা উন্নয়ন বরাদ্দেও বগুড়া পিছিয়ে পড়তে থাকে। প্রচলিত এবং অত্যাবশ্যকীয় ছাড়া কোনো কাজ হয়নি এ জেলায়।
শিক্ষাবিদ ফজলুল করিম বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় একটি জেলা পরিচিতি পেতে পারে না। এখানে বিএনপির যেমন ভোট রয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগের ভোটও কম নয়। এ কারণে উন্নয়ন বঞ্চিত করে রাখা ঠিক সিদ্ধান্ত নয়।
শহরের সাতমাথা এলাকার ব্যাংকার হাবিবুল হক বলেন, রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হলে উন্নয়নের বিকল্প নেই। বগুড়া একটি ব্যবসা-সফল এলাকা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দেশের সুষম উন্নয়ন প্রত্যাশা করছি।
স্কুলশিক্ষিকা ফজিলাতুন নাহার বলেন, আমাদের পাশের জেলাগুলোও অনেক উন্নত হয়েছে। নতুন রাস্তাঘাট, অবকাঠামো হয়েছে। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব। আমরা চাই বগুড়া আরও এগিয়ে যাক।
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) বগুড়ার সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, জেলার উন্নয়ন ছাড়াও শিক্ষা, যুবসমাজ এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন, কৃষি খাত, ক্ষুদ্র শিল্প, তরুণ এবং নারী উদ্যোক্তাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বগুড়া দীর্ঘদিন এসব থেকে বঞ্চিত।
- বিষয় :
- বগুড়া
- উন্নয়ন প্রকল্প
- বিএনপি
- আওয়ামী লীগ