গ্লাভস মাস্ক না পরেই জমিতে সার কীটনাশক
প্রতি মাসে ১৮০ থেকে ২২৫ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত, রোগীদের বেশির ভাগই কৃষিকাজে জড়িত

আমন ধানের ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করছেন কৃষক। ছবিটি চারঘাট উপজেলার ভাটপাড়া এলাকা থেকে তোলা
সনি আজাদ, চারঘাট রাজশাহী
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২০:৫৪ | আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২০:৫৪
দুর্গাপুর উপজেলার পানানগর গ্রামের রবিউল ইসলামের আমনক্ষেতে ছত্রাক আক্রমণ করেছে। তিনি পিঠে বালাইনাশকের জার নিয়ে জমিতে টুপার কীটনাশক স্প্রে করছিলেন। হাফহাতা টি-শার্ট, হাতে গ্লাভস নেই, মুখে মাস্কও নেই।
রবিউল বলেন, কীটনাশক স্প্রে করার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আছে বলে শুনিনি। খালি হাতে ও মুখ না ঢেকেই স্প্রে করি। মাঝেমধ্যে মাথা ঘোরে, ব্যথা হয়। তখন বেশি পানি দিয়ে গোসল করি। দোকান থেকে মাথাব্যথার ওষুধ খাই। এভাবেই কাজ করছি বছরের পর বছর।
চারঘাট উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের কৃষক শাহজাহান আলীর ভাষ্য, কৃষি অফিসে প্রশিক্ষণে গেলে কীটনাশক স্প্রে করার নিয়ম শিখিয়ে দেয়। কিন্তু মাঠে কাজ করার সময় এসব মনে থাকে না। এ ছাড়া হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক কেনার টাকাও নেই। কৃষি অফিস এসব প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করলে নিম্নআয়ের কৃষকেরা উপকৃত হতো।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) ও গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস (জিএপি) নীতিমালার পরামর্শ হলো, রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহারের সময় মাস্ক, গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে। শরীরের অন্যান্য অংশে কীটনাশকের অনুপ্রবেশ রোধে প্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ছাড়া বাতাসের উল্টো দিকে প্রয়োগ করা যাবে না। এসব নিয়ম মানছেন না রবিউল ইসলাম ও শাহজাহান আলীর মতো রাজশাহীর বেশির ভাগ কৃষক। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই কীটনাশক স্প্রে ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে তাদের। অজান্তেই শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগসহ ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।
চারঘাটের রাওথা এলাকার শফিকুল ইসলাম আমবাগানে কীটনাশক প্রয়োগের কাজ করেন। বর্তমানে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। শফিকুল জানান, প্রথম প্রথম মাথা ব্যাথা করত, কাঁশি হতো। একপর্যায়ে আর কাজ করতে পারছিলেন না। পরীক্ষার পর জানা গেল ক্যান্সার হয়েছে। কাজের ধরন শুনে চিকিৎসক বলেছেন, অসাবধানতার কারণেই এ রোগ হতে পারে।
জিরো বাজেট ন্যাচারাল ফার্মিং রাজশাহীর জরিপ বলছে, কোনো ধরনের সুরক্ষা উপকরণ বা ব্যবস্থা ছাড়াই কীটনাশক ও হরমোন প্রয়োগ করছেন রাজশাহীর ৮৫ শতাংশের বেশি কৃষক। ফলে রাসায়নিক ও কীটনাশকের ক্ষতিকর সূক্ষ্ম উপাদানগুলো দেহে প্রবেশ করে মরণব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একই সঙ্গে তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় মোট কৃষিজমির পরিমাণ ১ লাখ ৮১ হাজার ৬০৯ হেক্টর। এই জমিতে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬৭০ টন ইউরিয়া, ১ লাখ ৫ হাজার ১১৪ টন টিএসপি, ১ লাখ ৪৬ হাজার ২০০ টন এমওপি ও ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৩২ টন ডিএপি সার ব্যবহার হয়। এ ছাড়াও নানারকমের কীটনাশক ও হরমোন ব্যবহার হয়ে থাকে। জেলায় ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে।
জিরো বাজেট ন্যাচারাল ফার্মিংয়ের প্রশিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, কীটনাশকমুক্ত কৃষি গড়ে তুলতে আমরা কাজ করছি। এতে কীভাবে কীটনাশক ব্যবহার ছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ফসল আবাদ করা যায়, তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। চারঘাট ও বাঘা উপজেলাতেই প্রায় ৩০০ জন কৃষককে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহীর উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, কীটনাশক স্প্রে করার আগে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসচেতনতা মেনে চলার পাশাপাশি আইপিএম অনুযায়ী ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অনেক কৃষক তা মানছেন না।
জেলা রোগী কল্যাণ সমিতির সূত্রে জানা গেছে, জেলার প্রতিটি উপজেলায় মাসে ২০ থেকে ২৫ জন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা সহায়তার জন্য আবেদন করেন। সে হিসাবে নয়; উপজেলায় ১৮০ থেকে ২২৫ জন আক্রান্ত হচ্ছে। বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৭০০ জন। বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি। রোগীদের বেশির ভাগই কৃষিকাজে জড়িত। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।
জেলা রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও সিভিল সার্জন আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, রাসায়নিক ও কীটনাশক স্প্রে করার আগে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। না হলে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে এসব বিষ প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি মাথাব্যথা, বমি বমি ভাবসহ নানারকম জটিল রোগ হতে পারে। এমনকি ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতেও আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।
- বিষয় :
- কীটনাশক
- স্বাস্থ্যঝুঁকি
- রাজশাহী
- চারঘাট