ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

জেলা প্রশাসনের কর্মচারীদের কাছে জিম্মি নোয়াখালীর সেবা প্রত্যাশীরা

দীর্ঘদিন একই পদে থেকে কোটিপতি পিয়নরা, অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে

জেলা প্রশাসনের কর্মচারীদের কাছে জিম্মি নোয়াখালীর সেবা প্রত্যাশীরা

ফাইল ছবি

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৯:২৬ | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৯:৫৫

নোয়াখালী জেলা প্রশাসনে সেবা প্রত্যাশী মানুষ কর্মচারীদের হাতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তৃতীয় শ্রেণির কিছু কর্মচারী সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের অর্থ। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা বারবার অভিযোগ করলেও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। উল্টো কর্মচারীরা ১০-১৫ বছর ধরে একই পদে খুঁটি গেড়ে থাকায় হয়রানি আরও বেড়েছে। নানা অপকর্ম করে কর্মচারী একেকজন হয়েছে কোটিপতি। সরকারি স্ট্যাম্প-কোর্ট ফি জালিয়াতি, বিক্রি ও পাচার, রাজস্ব তছরুপ, ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়ম এবং কর্তাব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে নিয়োগবাণিজ্য করে পিয়নদের এই চক্রটি অল্পদিনেই ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কর্মচারী সিন্ডিকেটের ইশারাতেই পদায়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করা হতো জেলায়। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না ডিসি অফিসের এডিসি ও সহকারী কমিশনাররাও।

সম্প্রতি সাধারণ মানুষ কর্মচারীদের এসব হয়রানির বিষয়ে একটি আবেদন বিভিন্ন দপ্তরে জমা দিয়েছেন। নির্দিষ্টভাবে তৃতীয় শ্রেণির কিছু কর্মচারীর নামসহ অনিয়মের বিস্তুারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

আবদুর রহিম ৯০ এর দশকে পিয়ন পদে চাকুরিতে যোগদান করলেও ২০০৩ সালের দিকে তৃতীয় শ্রেণির অফিস সহকারী পদে পদোন্নতি পেয়ে এখনও রাজস্ব শাখায় কর্মরত আছেন। বিভিন্ন সময় তাকে নাটকীয় বদলি করা হয়। রাজস্ব শাখায় টানা ৪-৫ বছর চাকরির পর কাগজে-কলমে তাকে উপজেলায় বদলি দেখনো হয়। কিন্তু বাস্তবে প্রেষণে বা সংযুক্তিতে ওই রাজস্ব শাখাতে তাকে রেখে দেওয়া হয়। এরপর আবার ৪-৫ বছর প্রেষণে থাকার পর তাকে আবার কাগজ-কলমে বদলি করে প্রেষণ বা সংযুক্তি কথাটি বাতিল করে সরাসরি রাজস্ব প্রশাসনেই বদলি করা হয়। বদলি হলেও তার চেয়ার থাকে অনড়। রাজস্ব প্রশাসনে তিনি কাজ করছেন ২০ বছর ধরে। আবদুর রহিম বাংলাদেশ কালেক্টরেট সহকারী সমিতি (বাকাসস) নোয়াখালী শাখার সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস করেন না। ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, জেলা রেকর্ডরুম, এসিল্যান্ড অফিস ও তহশিল অফিসে তার পছন্দমত লোক পদায়ন করা হয়। ভূমি অফিস থেকে আর্থিক লেনদেন তিনিই করেন।

ডিসি অফিসের জেলা নাজির বেলায়েত হোসেন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। পদোন্নতি হওয়ার পরও তিনি এই পদই আকড়ে ধরে আছেন। তিনি সাধারণ প্রশাসনের ১৯৯৯ সালে ৩য় শ্রেণির কর্মচারী পদে নিয়োগ পান। সাধারণ প্রশাসনে নিয়োগের পরও তিনি চাকরির শুরু থেকেই উপজেলা ভূমি অফিসগুলোতে কাজ করেছেন। এরপর তিনি পদোন্নতি পেয়ে জেলা নাজিরের দায়িত্বে আসেন। তার সমসাময়িক কিংবা একই গ্রেডের কর্মচারীরা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়েছেন। কিন্তু তিনি পদোন্নিত নেননি বলে জানা গেছে।

অফিস সহকারী হারাধন চন্দ্র পাল ২০০৫ সালে সাধারণ প্রশাসনের ৩য় শ্রেণির কর্মচারী পদে নিয়োগ পান। তিনি সাধারণ প্রশাসনের কর্মী হয়েও শুরু থেকে ভূমি অফিসগুলোতে চাকরি করে গেছেন। সিন্ডিকেটের এই সদস্য বর্তমানে কোম্পানীগঞ্জ এসিল্যান্ড অফিসে কর্মরত আছেন। সাধারণ শাখার কর্মচারী হয়েও তিনি কখনো ইউএনও অফিসে যোগদান করেননি।

আশিষ কুমার দাস চাকরির শুরু থেকে ২০ বছর ধরে জেলা প্রশাসনের জেএম শাখায় পড়ে আছেন। সম্প্রতি তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। প্রেষণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে এতদিন জেএম শাখায় বসে টাকা গুনছেন তিনি।

হেদায়েত উল্যাহ সম্প্রতি প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। ডিসি অফিসের রাজস্ব শাখায় অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করে তারপর উচ্চমান সহকারী হয়েছিলে। তাও আগের চেয়ার ছাড়েননি। এরপর অফিস সুপারিনটেনডেন্ট হয়েছেন, তারপর প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এরপরও এই কর্মচারী আগের সেই অফিস সহকারীর চেয়ারেই বসে কাজ করছেন। প্রেষণ বা সংযুক্তির খেলায় তিনিও ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে রাজস্ব শাখায় বসে আছেন।

রিয়াজ উদ্দিন ২০০৫ সালে সাধারণ প্রশাসনের ৩য় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পান। সাধারণ প্রশাসনের কর্মী হয়েও তিনি শুরু থেকে ভূমি অফিসগুলোতে চাকরি করে গেছেন। বর্তমানে সিন্ডিকেট এর এই সদস্য ডিসি অফিসের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় আছেন।

মো. মোস্তফা সম্প্রতি প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। তিনি সাধারণ প্রশাসনের কর্মচারী হলেও চাকরির শুরু থেকে ভূমি অফিস, ডিসি অফিসের রাজস্ব শাখায় অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করছেনে। এরপর উচ্চমান সহকারী হয়েও আগের চেয়ার ছাড়েননি। এরপর অফিস সুপারিনটেনডেন্ট হয়েছেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পেয়েছেন- তারপরও অফিস সহকারীর চেয়ারেই বসা। অন্য উপজেলায় পদায়ন দেখিয়ে তাকে ভূমি অধিগ্রহণ শাখার চেয়ারেই রাখা হয়েছে। প্রেষণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে ১৫ বছর রাজস্ব শাখার বিভিন্ন সেকশনে চাকরি করেছেন।

রেজাউল করিম ২০১৬ সালে এডিসি (সার্বিক) এর গোপনীয় সহকারী পদ দিয়ে চাকরি শুরু করেন। এর পর পরিবার পরিকল্পনা সহকারী, সহকারী শিক্ষক নিয়োগসহ জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বর্তমানে তিনি উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা (সিএ টু ডিসি) পদে কর্মরত।

সাইফুজ্জামান পুলক সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে ২০১৬ চাকরি পান। কিন্তু চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই তিনি ডিসির প্রটোকলে কাজ করেন নেজারত শাখায়। সেখানে যোগদান করেই তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে উপজেলা ভূমি অফিস নোয়াখালী সদরে বদলি হন। তিনি কখনই সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করেননি।

নুরুন্নাহার অফিস সহকারী হিসেবে ১৯৯৯ সালে যোগদান করার পর থেকে জেলা রেকর্ডরুমে কাজ করছেন। মাঝে মাঝে তাকে অন্য শাখায় বদলি করে ঘুরিয়ে ২-১ মাসের মধ্যে আবার রেকর্ডরুমে নিয়ে আসা হয়। এভাবেই সে ১৯৯৯ সাল থেকে সাধারণ প্রশাসনের কর্মচারী হয়েও এক দিনের জন্যও উপজেলা প্রশাসনে বদলি নেননি।

এ ছাড়া সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় কর্মরত উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফাইমুন হেসেন, চাটখিল উপজেলা ভূমি অফিসের অফিস সহকারী জসিম উদ্দিন এবং জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে রাজস্ব শাখার অফিস সহকারী রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধেও আছে একই রকম অভিযোগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এই কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে চাকরি করাটাই কঠিন হয়ে যাবে। তাই কেউ কিছু বলছে না। নোয়াখালীর মাইজদীর হরিনারায়নপুরের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, এরা পিয়ন হলেও অনেক বড় হাত এদের আগলে রাখে। প্রশাসন, ক্ষমতাবানদের সমর্থনের কারণে ওদের কিছুই হয় না। এসবের সঙ্গে যুক্ত সবার বিরুদ্ধে উচ্চতর তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত।

জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, আমি কর্মচারীদের বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।

আরও পড়ুন

×