ইউএনওর কাঁধে ১৯০ পদের ভার

সাদুল্লাপুর ইউএনও কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষায় সেবা নিতে আসা মানুষ। একই স্থানে সেবাপ্রত্যাশীদের মোটরসাইকেলের সারি সমকাল
শাহজাহান সোহেল, সাদুল্লাপুর (গাইবান্ধা)
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:০৫
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৬টি। দাখিল ও আলিম পর্যায়ের ৩৭টি মাদ্রাসা রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ আছে ১৪টি। প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতার কাগজে স্বাক্ষর করতে হয় ইউএনওকে। দেখতে হয় তাদের ফাইলপত্রও। কোনো প্রতিষ্ঠানের মামলা থাকলে সেখানে বাড়তি সময় ব্যয় হয়। এ ছাড়া উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি হিসেবে তাঁকে ১৯৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্বও সামলাতে হচ্ছে। জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি না থাকায় এভাবে অন্তত ১৯০টি পদের দায়িত্ব সামলাতে গলদঘর্ম অবস্থা ইউএনওর।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দপ্তরের স্থায়ী কমিটির ৯টিতে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আর আটটিতে পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কয়েকটি কমিটিতে উপদেষ্টা এবং ৮ থেকে ১০টি কমিটির সভাপতির দায়িত্বে থাকেন। তবে তারা না থাকায় সব কমিটির দায়িত্ব এখন ইউএনওর কাঁধে। এ তথ্য জানিয়েছেন উপজেলা পরিষদের অফিস সহকারী রেজওয়ান হোসেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পদ দখলের প্রতিযোগিতা চলে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর মধ্যে। এ জন্য আর্থিক লেনদেন থেকে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটে। পদ না পেলে দাঙ্গা-হাঙ্গামাও বেধে যায়। শেষে এসব পদের দায়িত্ব সামলান তারা। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তাদের সে সুযোগ নেই। পদাধিকার বলে সব সভাপতি পদের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন ইউএনও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ইউএনওর ওপর চাপ কমাতে কিছু কাজ অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া যেতে পারে। কারণ ইউএনওর পদটি এলাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাঁকে চাপমুক্ত রাখলে ভালো সেবা পাওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দপ্তর সেনা কর্মকর্তারা দেখতে পারেন। কাজে লাগানো যেতে পারে সুধী সমাজের প্রতিনিধিদের। এসব বাস্তবায়নে সরকারের ওপর মহলের সিন্ধান্ত এবং নির্দেশনা প্রয়োজন।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা কমিটি থেকে শুরু করে শিক্ষা, কৃষি উন্নয়ন, প্রতিবন্ধী ভাতা, হাটবাজার ব্যবস্থাপনা, বয়স্ক-বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি, মাতৃত্ব ভাতা, চোরাচালান প্রতিরোধ, এনজিও সমন্বয়, টেন্ডার, টিআর-কাবিটা, বিভিন্ন দিবস উদযাপন, ভিডব্লিউবিসহ উপজেলা পর্যায়ে সরকারি দপ্তরগুলোর বিভিন্ন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ইউএনও। এখন সমন্বয় সভাও পরিচালনা করতে হচ্ছে। সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব তাদের কাঁধে।
শিক্ষা অফিস থেকে জানা গেছে, রাজনৈতিক সরকার থাকলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পছন্দের লোককে সভাপতি বানানো হয়। এ সুযোগে দলীয় প্রভাবে অনেকে সভাপতি হন। কিন্তু এখন রাজনৈতিক সরকার না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদ থেকে দলীয় লোক বাতিল করা হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ইউএনও।
উপজেলা পর্যায়ে একজন ইউএনও স্বাভাবিকভাবে ৪০ থেকে ৪৫টি কমিটির সভাপতি থাকেন। এর সঙ্গে এখন আরও অন্তত দেড়শ পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বে আছেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার একটি উপজেলার ইউএনও বলেন, নিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় এত কমিটির দায়িত্ব পালন করা কষ্টকর। তবে ওপরের নির্দেশ মেনে নিতেই হবে। গাফিলতির সুযোগ নেই। চাপের মধ্যেও নাগরিক সেবা ঠিক রাখার চেষ্টা করছি।
উপজেলার সরকারি দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এতগুলো পদের দায়িত্বে থাকার কারণে ইউএনওর স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। কাজের চাপে এবং সময় স্বল্পতায় অধিকাংশ কমিটির সভায় হাজির হতে পারেন না তিনি। বাধ্য হয়ে এসব কমিটির সভার রেজুলেশনে বা প্রয়োজনীয় কাগজে পরে স্বাক্ষর করেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সভাপতি ছাড়াই সভা করতে হয়। তাঁর স্বাক্ষর নিতে হয়ে সভা শেষে। এতে সেবা নিতে আসা মানুষের কাজে বিলম্ব হয়।
ইউএনও কার্যালয়ের একজন অফিস সহকারীর ভাষ্য, তারা বাড়তি কাজের চাপে আছেন। অনেক সময় সন্ধ্যা, এমনকি রাত অবধি কাজ করতে হয়। ইউএনও অতিরিক্ত সময় নিয়ে অফিস করছেন। তিনি থাকলে কর্মচারী হয়ে তাদেরও আগে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য বাড়তি ভাতা না থাকলেও কাজ করতে হচ্ছে। কষ্ট হলেও দিনের কাজ দিনে সম্পন্ন করার চেষ্টা থাকে সবার।
উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আকতার বানু লাকি বলেন, তাদের কাছে প্রতিদিন শত শত মানুষ আসতেন বিভিন্ন ধরনের সেবা নেওয়ার জন্য। তবে দায়িত্বে না থাকায় সব কাজের চাপ পড়েছে ইউএনওর ওপর। জনপ্রতিনিধি থাকলে সব দপ্তরের কাজে গতি আসে। মানুষ দ্রুত সেবা পায়। এখন সাধারণ মানুষের সেবা পেতে বিলম্ব এবং হয়রানি হতে হচ্ছে।
সরকারি দায়িত্ব পালনে কোনো অজুহাত চলে না। কাজের চাপ থাকলেও সেবাপ্রত্যাশী কাউকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে না বলে জানান সাদুল্লাপুরের ইউএনও কাওছার হাবিব। তিনি বলেন, অফিসের কর্মীদের নিয়ে অতিরিক্ত সময় কাজ করছেন। ১১ ইউনিয়নের এ উপজেলায় দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে যাতে বিলম্বের ফাঁদে না পড়েন, সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে।
- বিষয় :
- সেবামুলক উদ্যোগ