চেয়ারম্যানের পেটে গরিবের চাল

ওয়াজেদ আলীর
শাহারুল আলম, জয়পুরহাট
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:৩৮
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ওয়াজেদ আলীর বিরুদ্ধে দুস্থদের চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বিতরণের তালিকায় নাম থাকলেও চাল পাননি অনেকে। ইউনিয়নের ১৯ উপকারভোগীর নামে বরাদ্দের ২৪ মাসের মধ্যে ১৮ মাস চাল উত্তোলন করেছেন চেয়ারম্যান নিজেই। গত জুলাই ও আগস্ট মাসের চাল বিতরণ করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য বেরিয়ে আসে। ইউপি সদস্যরা বলছেন, খোঁজ নিলে আরও অনেক ভুক্তভোগীর কথা জানা যাবে।
গত বুধবার উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই চেয়ারম্যান ওয়াজেদ আলী পলাতক। জেলার বিভিন্ন ঘটনায় তিনি কয়েকটি মামলার আসামি হয়েছেন। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে দলীয় প্রভাবের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতেন না। বর্তমানে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম।
ভিজিডি কার্ডধারী হতদরিদ্রদের গত জুলাই ও আগস্ট মাসের বরাদ্দের চাল আসে ইউনিয়ন পরিষদে। সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে কার্ডধারী ৪২৯ জন উপকারভোগীকে প্রতি মাসের ৩০ কেজি চাল নিতে ইউনিয়ন কার্যালয়ে আসতে বলা হয়। তাদের মধ্যে ১৯ জনের চাল গত এক মাসে কেউ নিতে আসেননি। গত দুই মাসের ১৯ জনের মোট ৩৮ বস্তা চাল ইউনিয়ন পরিষদের গুদামে মজুত থাকতে দেখা গেছে।
ভুক্তভোগী, ইউপি সদস্য ও এলাকাবাসী জানান, গত দুই মাস ধরে বিতরণ না হওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের গুদামে ১৯ জন দুস্থের মোট ৩৮ বস্তা চাল মজুত রয়েছে। ইউপি সদস্য ও উপজেলা মহিলাবিষয়ক কার্যালয়ের পক্ষে তালিকা ধরে ভুক্তভোগীদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলা হয়। ১৩ জন কার্ডধারীর সন্ধান পেয়েছেন তারা। ছয়জনের সন্ধান এখনও পাননি। যাদের সন্ধান পেয়েছেন তারা বরাদ্দ বিষয়ে গত ১৮ মাস ধরে কিছুই জানেন না। এমনকি তারা কখনও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৩০ কেজি দূরের কথা, এক ছটাক চালও উত্তোলন করেননি। শুধু ১৯ জনই নন, ভালোভাবে খোঁজ নিলে ওই তালিকা থেকে কমপক্ষে আরও ৫০ জনেরও বেশি নাম বেরিয়ে আসবে বলে জানান বর্তমান ইউপি সদস্যরা। গত ১৮ মাসে যে তথ্য জানা যায়নি, তা এক মাসেই বেরিয়ে আসে।
তালিকায় নাম আছে কিন্তু ১৮ মাস ধরে চাল পাননি ভুক্তভোগী দুর্গাপুর-বহুতী গ্রামের বাসিন্দা মোছা. মাহমুদা। তিনি বলেন, ‘আমি তো চালের বিষয়ে কিছুই জানি না। কয়েক দিন আগে লোকজন এসে বলছে, তোমার চাল গুদামে আছে, তুমি কেন নিয়ে আসোনি? আমি তাদের বলেছি, কীসের চাল! আর আমি কেন চাল নিয়ে আসব? পরে সবকিছু বুঝিয়ে বললে আমি তাদের বলেছি, চাল দিলে গত ১৮ মাসেরও দিতে হবে।’
চাল না পাওয়া আরেক ভুক্তভোগী মান্দাই গ্রামের মোছা. দেলোয়ারা বলেন, ‘চাল বরাদ্দ হয়েছে আমাদের মতো গরিবের নামে। আর সেই চাল গত ১৮ মাস ধরে বিক্রি করে খাচ্ছেন চেয়ারম্যান নিজেই। আমরা তাঁর উপযুক্ত শাস্তি চাই।’
উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন, মামলার পর চেয়ারম্যান না পালালে হয়তো এসব জানা যেত না। আগে কাউকে কিছুই বুঝতে দেননি। তিনি বলেন, ‘বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাহিদুলও এ চাল বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। আমরা বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেছি। এর পর তিনি ওই চাল আর বিক্রি করতে পারেননি।’
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, জুলাই ও আগস্ট মাসের চাল আসছে। সব ইউপি সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে তালিকা ধরে চাল বিতরণ করেছি।
উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মাহফুজা খাতুন বলেন, নির্বাহী কর্মকর্তার আদেশে তালিকা অনুযায়ী চাল নিতে না আসা কার্ডধারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কার্ডধারীরা জানিয়েছেন, তাদের নামে চাল বরাদ্দ বিষয়ে গত ১৮ মাস জানেন না কেউ। এটা দুঃখজনক। ১৯ জনের মধ্যে ১৩ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে। এখনও ছয় জনের খোঁজ মেলেনি। এ বিষয়ে তদন্ত চলমান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামিমা আক্তার জাহান বলেন, ভুক্তভোগীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা গত ১৮ মাসের চাল চান। আমি কোথা থেকে তাদের এ চাল দেব? এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। অভিযোগ প্রমাণ হলে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- বিষয় :
- চাল আত্মসাৎ