ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

দরিদ্র নারীদের নামে কার্ড চাল তুলছেন বিত্তবানরা

দরিদ্র নারীদের নামে কার্ড চাল তুলছেন বিত্তবানরা

ফাইল ছবি

আনোয়ার হোসেন মিন্টু, জামালপুর

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:১২

দুস্থ নারীদের প্রতিটি কার্ডে মাসে ৩০ কেজি করে চাল বরাদ্দ করে সরকার। তবে অধিকাংশ কার্ডধারী পাচ্ছেন না বরাদ্দের চাল। অনেকে জানেনও না তাদের নামে সহায়তার কার্ড হয়েছে। অথচ এসব চাল প্রতি মাসে ঠিকই তুলে নেওয়া হচ্ছে।
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদ চরপুঁটিমারী। এখানকার ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মোতালেব হোসেন। তাঁর দুই স্ত্রীর নামে রয়েছে এই খাদ্য সহায়তার কার্ড। এর মধ্যে মোর্শেদা বেগমের কার্ড নম্বর ৩২০ এবং ছালমা বেগমের কার্ড নম্বর ৬৫।
দুই স্ত্রীর নামে কার্ড বরাদ্দের বিষয়ে প্রশ্ন করলে মোতালেব মেম্বার জানান, অভাবে স্বভাব নষ্ট, নির্বাচন করতে গিয়ে সর্বহারা হয়েছেন। বিক্রি করেছেন বাড়ি-ভিটার ১০ কাঠা জমি। ঋণী হয়েছেন ২০ লাখ টাকা। পাওনাদারদের চাপে তিনি এখন এলাকা ছেড়ে ঢাকার সাভারে গিয়ে ট্রাক চালাচ্ছেন।
শুধু মোতালেব মেম্বারই নন, পরিষদের অধিকাংশ কার্ড জনপ্রতিনিধি ও কালোবাজারিদের কবজায় বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে নাম থাকলেও চাল পাচ্ছেন না অনেকেই। গত জুলাই ও আগস্ট মাসের চাল বিতরণের সময় এ তথ্য বেরিয়ে আসে।
জানা গেছে, ভারনারেবল উইমেনস বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) কর্মসূচির মাধ্যমে দুস্থ নারীদের খাদ্য সহায়তার লক্ষ্যে অনলাইন ও পরিষদের মাধ্যমে আবেদন নেওয়া হয়। গত বছরের জানুয়ারি মাসে চরপুঁটিমারী ইউনিয়নের ৩২৫ দুস্থ নারীর নামে এ কার্ড দেওয়া হয়। প্রতিটি কার্ডে বরাদ্দ রয়েছে ৩০ কেজি চাল। দুই বছর মেয়াদি এই কার্ডের সুবিধা মিলবে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ইতোমধ্যে ২২ কিস্তির চাল বিতরণ দেখানো হয়েছে।
বেনুয়ারচর সর্দারপাড়া গ্রামের সাজেদার ৬ সদস্যের সংসার। তাঁর স্বামী আবুল হোসেন মারা গেছেন ৭ বছর আগে। এর পর থেকেই কৃষি শ্রমিকের কাজ করে ছেলে-মেয়ে নিয়ে অতি কষ্টে দিন গুজরান করছেন তিনি। তাঁর নামেও ভিডব্লিউবির কার্ড রয়েছে। সেই কার্ডের চাল উত্তোলন হচ্ছে ২২ মাস ধরে। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর হাতে দেওয়া হয়নি কার্ডটি। তাঁর ভাগ্যে জোটেনি এক ছটাক চালও। 
একই গ্রামের বাসিন্দা শ্যামলী আক্তার শ্রাবণী। তাঁর নামেও ২২ কিস্তির চাল বিতরণ দেখানো হয়েছে। অথচ তিনি এ প্রতিবেদকের কাছেই প্রথম শুনলেন তাঁর নামে কার্ড হয়েছে প্রায় দুই বছর আগে। এ চাল কার হাঁড়িতে গেছে, তাঁর নামের কার্ডইবা কার কাছে– কিছুই জানেন না তিনি। তবে একটি কার্ডের জন্য চেয়ারম্যান, মেম্বার ও নেতাদের পেছনে দীর্ঘদিন ঘোরাঘুরির তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। একই পরিণতি বেনুয়ারচর বেপারিপাড়ার ২৭৬ নম্বর কার্ডধারী রাজিয়া আক্তারের, ১১২ নম্বর কার্ডধারী সবুজা বেগমের। তবে ১৮ মাস পর প্রথমবারের মতো চাল পাওয়ার কথা জানান ১৩৭ নম্বর কার্ডধারী রেনুয়ারচর গ্রামের মোছা. রুকেয়া। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর স্থানীয় বিএনপি নেতাদের হস্তক্ষেপে চাল পেতে শুরু করেছেন। তবে ১৮ কিস্তির চাল পাননি।
স্থানীয়দের দাবি, এই ইউনিয়নের ৩২৫টি কার্ডের বেশির ভাগই স্থানীয় কালোবাজারিদের কবজায়। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় সেলিম মিয়া, খোরশেদ ওরফে মেঘা, জহুরুল, আবুল কাশেম ঘটু মেম্বার ও ফারুকের নেতৃত্বে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে এসব কার্ড নিজেদের কবজায় রেখেছেন। বিতরণের দিন নিজস্ব লোক দিয়ে চাল উত্তোলন করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথম দিন ট্যাগ অফিসারের উপস্থিতিতে প্রকৃত কার্ডধারীদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হলেও দ্বিতীয় দিন দেওয়া হয় কালোবাজারিদের কবজায় থাকা কার্ডের চাল। 
অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে চরপুঁটিমারী ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা উমর ফারুকের কাছে কার্ডধারীদের তালিকা চাইলে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার ভাষ্য, চেয়ারম্যান শামছুজ্জামান তাঁর ব্যক্তিগত লকারে তালিকা তালাবদ্ধ করে রেখেছেন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এ কর্মসূচির আওতায় জেলায় কার্ডের সংখ্যা ২১ হাজার ২১টি। বিপরীতে প্রতি মাসে চাল উত্তোলন হচ্ছে ৬৩০ দশমিক ৬৩ টন, যার বেশির ভাগই পৌঁছে না প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাছে।
বক্তব্য জানতে চেয়ারম্যান শামছুজ্জামানের (সুরুজ মাস্টার) মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে পরে কথা বলবেন বলেই লাইন কেটে দেন। পরে একাধিকবার কল করলেও রিসিভ করেননি।
ইসলামপুরে ইউএনও তৌহিদুর রহমানের ভাষ্য, এই কর্মসূচির কার্ড বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে শিগগির এসব কার্ড বাতিল হয়ে যাবে। তবে চরপুঁটিমারী ইউনিয়নের দুর্নীতির বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জামালপুর মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কামরুন্নাহার সমকালকে বলেন, যাচাই-বাছাই ও কার্ড বিতরণ তারাই করেছেন। তবে দুস্থদের পক্ষ থেকে অভিযোগ না পাওয়ায় ব্যবস্থা নিতে পারেননি। 
জেলা প্রশাসক হাসিনা বেগমের ভাষ্য, বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব হচ্ছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের। তবে তদন্ত করে চাল আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×