আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে মাছ চাষে সাফল্য

ত্রিশালে প্রকল্পের পুকুরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে এয়ারেটর যন্ত্র সমকাল
মতিউর রহমান সেলিম, ত্রিশাল (ময়মনসিংহ)
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১০
ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা ইউনিয়নের প্রান্তিক মাছ চাষি মাহফুজুর রহমান। গত বছর তাঁর একটি পুকুরে ৩৫০ গ্রাম ওজনের ১৪ হাজার মাছ মারা যায়, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৬ লাখ টাকা। চলতি বছরের শুরুতে তাঁর আরেকটি পুকুরের ১০ টন শিং মাছ মারা যায়, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ২০ লাখ টাকা। পরীক্ষা করে পানিতে কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। ঠিক কী কারণে মাছগুলো মারা গেল, তাও জানতে পারেননি।
নিয়মিত খাবার সরবরাহ ও পরিচর্যার পরও লোকসানের মুখে পড়েন মাহফুজের মতো অনেক খামারি। এ অবস্থায় পরীক্ষামূলক অ্যাকুয়া কালচার ৪ দশমিক ০ প্রযুক্তি ও বিদ্যমান পুকুরে ভার্টিক্যাল এক্সপানশন পদ্ধতির মাধ্যমে সফলতা অর্জন করেছে উপজেলা প্রশাসন।
আধুনিক ওই ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপস জানান দেয় পুকুরে অক্সিজেন, পিএইচ, টিডিএস, তাপমাত্রার পরিমাণ। সেই মাত্রার ভিত্তিতে সয়ংক্রিয়ভাবে এয়ারেটর ডিভাইস অন বা অফ করে। অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বাড়ল কিনা, সেটা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে এর পরিমাণ বেড়ে গেলে সয়ংক্রিয়ভাবে ড্রেনেজ পাম্প অন করে পুকুরের তলদেশের বর্জ্য পদার্থ কমাতে কাজ করে। মাছের প্রজাতি অনুসারে কখন কী পরিমাণ খাবার প্রয়োজন, সেটা জানা যায়। সে অনুযায়ী সয়ংক্রিয় ফিডার মেশিন খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এসবে মানুষের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন পড়ে না। ‘রেইন সেন্সর ও ওয়েদার ফোরকাস্টিং টুলস’ ব্যবহারের ফলে মাছ চাষি বৃষ্টির সম্ভাবনা ও তাপমাত্রা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য আগে থেকেই জানতে পারেন। একটি চাষ চক্রে খামারে কী পরিমাণ বিদ্যুতের ব্যবহার হয়েছে, কত কেজি খাবার পুকুরে প্রয়োগ করা হয়েছে, কোনো এয়ারেটন যন্ত্র কত সময় ধরে চলেছে, তার সঠিক ও নির্ভুল হিসাব অ্যাপসের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এসব বিষয় সাধারণ চাষিদের অজানা থাকার কারণে মাছ বিক্রির পর অধিকাংশের লোকসান গুনতে হয়।
পরীক্ষামূলক চাষে সফল হওয়ায় এখন প্রশিক্ষণ ও চাষি পর্যায়ে প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে ত্রিশাল উপজেলা প্রশাসন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এক একর জমির পুকুরে এই প্রযুক্তি অনুসরণ করে মাছ চাষ করলে সেন্সরসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্রয়ে খরচ হবে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা।
এ প্রকল্পের টেকনিশিয়ান রনি সাহা বলেন, এই অ্যাকুয়া কালচার ৪.০ প্রযুক্তি ও বিদ্যমান পুকুরে ভার্টিক্যাল এক্সপানশন পদ্ধতির ১৮ থেকে ২০ ফুট গভীরতার পুকুরে শতাংশে ১ হাজার ২০০ মাছ
চাষ করা যায়, যা সাধারণের তুলনায় ৫ গুণ বেশি। অল্প জমিতে বেশি মাছ চাষ করার পাশাপাশি সাশ্রয় হয় খাবার।
জানা গেছে, অল্প জমিতে অধিক মাছ চাষ করে কীভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় এবং কীভাবে লোকসানের হাত থেকে মৎস্য খামারিদের রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা ও গবেষণা করেন ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুয়েল আহমেদ। বছরখানেক আগে কানিহারী ইউনিয়নে ৫৮ শতাংশের একটি সরকারি পুকুরে পরীক্ষামূলক নিজের উদ্ভাবিত অ্যাকুয়া কালচার ৪.০ প্রযুক্তি ও বিদ্যমান পুকুরে ভার্টিক্যাল এক্সপানশন পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেন। মেলে অভূতপূর্ব সফল্য।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ৫৮ শতাংশের ১৮ ফুট গভীর ওই পুকুরে ৬৫ হাজার পাঙাশের পোনা ছাড়া হয়। প্রতি শতাংশে পড়েছে ১ হাজার ১০০-এর বেশি মাছ, যার প্রতিটির গড় ওজন ছিল ৫৫ গ্রাম।
৬ মাসে প্রতিটি মাছের গড় ওজন দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৫০ গ্রামে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে ৬৫ হাজার পাঙাশের পোনা দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের করতে হলে সাড়ে ৪ একর জমির প্রয়োজন হয় বলে জানান সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সামসুজ্জামান। কেননা, সাধারণ মৎস্য চাষের পুকুরের গভীরতা থাকে ৫-৬ ফুট। শতাংশে চাষ করা যায় ১৫০ থেকে ২০০টি পাঙাশ। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের পুকুর পরিদর্শনে এসে অবাক করার মতো যা দেখলাম তা হলো, এত ঘন মাছ থাকা সত্ত্বেও ৬ মাস পালনে প্রতিটি মাছের গড় ওজন ১ হাজার ২৫০ গ্রাম হয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে অবশ্যই চাষিরা উপকৃত হবেন।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুয়েল আহমেদ জানান, এই প্রযুক্তি ব্যবহারে অল্প জমিতে অধিক মাছ চাষ করে খুবই লাভবান হওয়া যাবে।
- বিষয় :
- পুকুর