হাজার কোটি টাকা ব্যয় কানাকড়ি সুফলও নেই

.
আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৬ | আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:০৩
হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তার কোনো সুফল মিলছে না। উল্টো প্রকল্পগুলো এখন ‘গলার কাঁটা’ হয়ে উঠেছে। ফতেয়াবাদে তিন কোটি টাকার আধুনিক গ্রামীণ বাজার ভবন চার বছরেও জনগণের জন্য চালু হয়নি। পাঁচ কোটির মিরসরাই ও আড়াই কোটির আনোয়ারার বাজার ভবনের একই হাল।
চাহিদা বিবেচনা না করে রেলওয়ের ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা সাড়ে পাঁচশ মালবাহী ওয়াগন খোলা আকাশের নিচে পড়ে রয়েছে। খাদ্যশস্য এবং পাথর পরিবহনের জন্য আমদানি করা হলেও এগুলো কোনো কাজেই লাগছে না। একইভাবে রেলওয়ের ৩৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ১২৫টি লাগেজ ভ্যান এখন লোকসানি খাতে রূপ নিয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় ৬০ কোটি টাকার চারটি ট্রমা সেন্টারও অকেজো। আধুনিক ভবন, যন্ত্রপাতি থাকলেও শুধু লোকবলের অভাবে নেই কোনো কার্যক্রম।
বছর আগে উদ্বোধন হলেও নকশা জটিলতায় ২৮১ কোটির চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চট্টগ্রাম শহীদ মিনার চালু করা যাচ্ছে না। অন্ধকারাচ্ছন্ন শহীদ মিনার তৈরির অভিযোগে শ্রদ্ধা জানানো থেকে বিরত রয়েছে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ। ডায়াবেটিক হাসপাতালের সামনে চার কোটি টাকার চলন্ত সিঁড়ির ওভারব্রিজ এখন পরিত্যক্ত। এভাবে চট্টগ্রামের রেলওয়ে, এলজিইডি, গণপূর্ত, সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর– পাঁচটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ‘বিলাসী প্রকল্পে’ হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও সাধারণ মানুষ তার সুফল থেকে বঞ্চিত।
সুজন-চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি-চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক সিকান্দার খান সমকালকে বলেন, সরকারি সংস্থাগুলো সমীক্ষা ছাড়াই শুধু প্রকল্প নিয়েছে। সাধারণ মানুষ তার সুফল পাবে কিনা, চিন্তা করেনি। তারা প্রকল্প ব্যয় থেকে মূলত লাভবান হওয়ার মানসেই এসব অকেজো প্রকল্প নিয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়েছে। যারা এসব অপচয়ের পেছনে রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের নেতা প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, চট্টগ্রামে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো প্রকল্প নেওয়ায় বাস্তবায়নের পর ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ছে। সরকারি অর্থ ব্যয় হলেও মানুষ তার সুফল ভোগ করতে পারছে না। কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে।
১১ কোটির তিন গ্রামীণ বাজার
চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই ও আনোয়ারায় গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় তিনটি আধুনিক বাজার ভবন তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালে হাটহাজারীর ফতেয়াবাদে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা মার্কেটটি এখনও চালু হয়নি। দোকান বরাদ্দ বিধিমালা জটিলতায় ভবনটি চালু করতে পারেনি এলজিইডি। সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার মিরসরাই উপজেলার কমরআলী বাজার ভবনও এক বছর ধরে চালু হচ্ছে না। আনোয়ারা উপজেলার সরকারহাটে আড়াই কোটি টাকার আধুনিক বাজার ভবনটির একই দশা।
এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী শাকিল হাওলাদার জানান, গ্রাম হবে শহর– এ ধারণা থেকে আধুনিক বাজার ভবন তৈরি করা হয়েছে। দোকান বরাদ্দসহ কিছু সমস্যার কারণে চালু করা যায়নি।
৬০ কোটির ৪ ট্রমা সেন্টার নিজেই ‘ট্রমায়’
চট্টগ্রামের রাউজান, লোহাগাড়া, হাটহাজারী ও ফেনীতে ৬০ কোটি টাকার ৪টি ট্রমা সেন্টার সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের কোনো কাজেই আসছে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জরুরি চিকিৎসা দিতে এসব তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়কের পাশে রাউজানে ১২ কোটি টাকা খরচ করে রাউজান ট্রমা সেন্টারের তিনটি ভবন তৈরি করে। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবরে উদ্বোধন করা হলেও চালু হয়নি ২০ শয্যার সেন্টারটি। রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুমন ধর বলেন, ভবন ছাড়া আর কিছু নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছি; যন্ত্রপাতি ও জনবল পেলে চালু করা হবে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে লোহাগাড়ায় পাঁচ কোটি টাকার ট্রমা সেন্টারটি ১০ বছরেও চালু হয়নি। ২০১৩ সালে উদ্বোধন হলেও জনবল ও যন্ত্রপাতি বরাদ্দ না দেওয়ায় নিজেই ট্রমায় রয়েছে সেন্টারটি। একই অবস্থা ৩০ কোটি টাকার ফেনী ট্রমা সেন্টারের। লোকবল না থাকায় সেন্টারের এক্সরে, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাফি, জেনারেটর, অপারেশন থিয়েটার ও প্যাথলজি ল্যাবের যন্ত্রপাতি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একই অবস্থা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ১২ কোটির হাটহাজারী ট্রমা সেন্টারের। ২০২১ সালে উদ্বোধনের পর তিন বছর পার হলেও চালুর কোনো খবর নেই। সেন্টারের মূল ফটকে ঝুলছে তালা। ট্রমা সেন্টারগুলো অকেজো থাকায় দুর্ঘটনায় আহতদের সেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
রেলের দুই প্রকল্প এখন ‘ফাঁস’
চাহিদা বিবেচনা না করে লাভের আশায় চারশ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে আনা রেলওয়ের মালবাহী ওয়াগন খোলা আকাশের নিচে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। খাদ্যশস্য এবং পাথর পরিবহনের জন্য আমদানি করা হলেও এগুলো কোনো কাজেই লাগছে না। ৫৬০টি ওয়াগনের মধ্যে ৩৮৬টি খাদ্যশস্যের এবং ১৭৪টি পাথর পরিবহনের জন্য আনা হয়। তার মধ্যে ৬০টি ওয়াগন গম পরিবহন করছে। পাথর পরিবহনে একটি ওয়াগনও ব্যবহার হয়নি। বর্তমানে ৫০০টি ওয়াগন চিটাগং গুডস পোর্ট ইয়ার্ডে খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকায় ব্যাটারি ও লোহার যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যাচ্ছে। ৪৬ টনের ওয়াগন আমদানির কথা থাকলেও বাস্তবে ৩১ টনের বেশি পরিবহন করতে পারছে না। ধারণক্ষমতায় কারসাজি করে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লুটপাটের অভিযোগও রয়েছে।
আবার কম সময়ে স্বল্প খরচে প্রান্তিক এলাকায় মালপত্র পৌঁছে দিতে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে যাত্রীবাহী আন্তঃনগর ট্রেনে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পণ্য পরিবহনে যুক্ত হয়েছিল লাগেজ ভ্যান। কিন্তু প্রত্যাশামতো মিলছে না সুফল। আয়ের চেয়ে লোকসানই বেশি। চীন থেকে ৩৫৮ কোটি টাকায় কেনা ১২৫টি লাগেজ ভ্যান চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে পাহাড়িকা ও উদয়ন, চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ রুটে বিজয় এক্সপ্রেসসহ আরও কয়েকটি রুটে কিছু মালপত্র পরিবহন করলেও খালিই থাকছে বেশি। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, আমার যোগদানের আগে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল। এখন কী অবস্থায় আছে, খবর নিয়ে জানতে হবে।
এ ছাড়া ‘চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স’ প্রকল্পের আওতায় ১৫ তলার ইনস্টিটিউট, ৮ তলাবিশিষ্ট মিলনায়তন ভবন, মাল্টিপারপাস হল, টানেল আকৃতির পাবলিক প্লাজা ও নতুন শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। গত বছরের ২৮ অক্টোবর এর উদ্বোধন হয়। আগের শহীদ মিনারটি সড়ক থেকে দেখা যেত। কিন্তু বর্তমান শহীদ মিনার সড়ক থেকে দেখা যায় না। অন্ধকার করে দেওয়ার অভিযোগ তুলে ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর ও গত ২৬ মার্চ শ্রদ্ধা নিবেদন করা থেকে বিরত থাকে নাগরিক সমাজ।
তবে গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ অভিযোগ অস্বীকার করে সবার মতামতের ভিত্তিতেই শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছে বলে দাবি করেন। এ ছাড়া ২০২০ সালে চার কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর মুরগি ফার্মে চলন্ত সিঁড়ির ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে এটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ডায়াবেটিক হাসপাতালে আসা রোগীদের সেবা দিতে তৈরি করা হলেও সাধারণ রোগী ও পথচারী এর সুফল থেকে বঞ্চিত।
- বিষয় :
- টাকা আত্মসাৎ
- প্রকল্প
- চট্টগ্রাম