ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ট্রাস্টি বোর্ডের দ্বন্দ্বের জের

সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র দখলের চেষ্টা

মারধরে আহত চিকিৎসকসহ কয়েক কর্মকর্তা

সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র দখলের চেষ্টা

সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাভার

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৫:০৬

সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করেছে একদল লোক। গতকাল মঙ্গলবার সকালে এ ঘটনা ঘটে। হাসপাতালটির চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের অভিযোগ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. নাজিম উদ্দিন আহম্মেদ লোকজন নিয়ে দখলের চেষ্টা চালান। তারা হাসপাতালটির একাধিক গেটে তালা লাগিয়ে দেন এবং বিভিন্ন কক্ষ ভাঙচুর করেন। তাদের মারধরে চিকিৎসকসহ কয়েক কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। এ সময় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন রোগী ও তাদের স্বজন। দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

জানা গেছে, গত ২৪ আগস্ট ডা. নাজিম উদ্দিন একটি অঙ্গীকারনামা করেন। সেই অঙ্গীকারনামায় তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা না দিয়ে স্বৈরাচার সরকারের পক্ষপাতিত্ব করার জন্য আমি লজ্জিত। এ কারণে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি থেকে অব্যাহতি নিলাম। ভবিষ্যতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, অঙ্গীকারের পরও গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে দলবল নিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যান ডা. নাজিম উদ্দিন। প্রথমে একদল লোক পিএইচএ ভবনের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় সেখানে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের বের করে দেয় তারা। এর পর বিভিন্ন কক্ষে হামলা চালিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়। সেখান থেকে তারা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মূল ভবনের দিকে আসে। ১০টার দিকে ডা. নাজিমের নেতৃত্বে অপর একটি গ্রুপ প্রধান গেট দিয়ে ঢোকে। সামনের এবং পেছনের দুই দিক দিয়ে ঢুকে দুটি গ্রুপ একত্র হয়। তাদের দেখে পুরো হাসপাতাল ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা প্রতিটি ফটকে তালা লাগিয়ে দেয়। এ সময় হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক আব্দুল হান্নান ও হিসাবরক্ষক শুভ বসাককে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে তারা গণমুদ্রণ অফিসে ঢুকে কর্মকর্তা ইমতিয়াজকে মারধর করে। এর পর লোকজন নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. আমিনুল ইসলামের কক্ষের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন ডা. নাজিম। লোকজন নিয়ে সেখানে বসে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ডেকে তিনি ঘোষণা দেন, ‘আমি এখন থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সব দায়িত্ব পালন করব।’ আমিনুল ইসলামকে বাদ দিয়ে ডা. উজ্জ্বল হাসানকে পরিচালকের দায়িত্ব দেন ডা. নাজিম। এভাবে দলবল নিয়ে ঘণ্টাখানেক সেখানে অবস্থান করেন তিনি। খবরটি ততক্ষণে ট্রাস্টি বোর্ডের অন্য সদস্যদের কাছে পৌঁছে যায়। তারা বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান। এর পর পুলিশ এসে পাঁচজনকে আটক করে। অবস্থা বেগতিক দেখে ডা. নাজিম তাঁর লোকজন নিয়ে পালিয়ে যান।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি সন্ধ্যা রায় সমকালকে বলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর পর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ডা. নাজিম বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে আসছেন। তিনি বোর্ডের দুই সদস্য অধ্যাপক আবুল কাশেম চৌধুরী ও আলতাফুন্নেসা মায়াকে সদস্য হিসেবে মেনে নিতে চাননি। কিন্তু আগে তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় কখনও বিষয়টি উত্থাপন করেননি। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর পর থেকে ডা. নাজিম অভিযোগ তুলছেন, অধ্যাপক আবুল কাশেম ও আলতাফুন্নেসাকে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য করার সময় তিনি সই করেননি। যে সই রয়েছে, সেটি তাঁর নয়। এ নিয়ে আদালতে মামলাও চলছে।

তিনি আরও বলেন, ২০২৩ সালের জুনে আওয়ামী লীগের লোকজন নিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নেন ডা. নাজিম। এর পর তাঁর পছন্দমতো ১০৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেন। তারা গত এক বছর তাঁর ব্যক্তিগত বাহিনী হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। এ ছাড়া ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাব খুলে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন নাজিম। নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেন। কিন্তু গত আগস্টে পট পরিবর্তনের পর ২৪ আগস্ট ডা. নাজিম অঙ্গীকার করেন, তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোনো কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকবেন না। এর পরও তিনি প্রতিষ্ঠানটি দখল করতে এসেছেন, যা খুবই দুঃখজনক।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, ডা. নাজিম তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে প্রতিষ্ঠান দখলের চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু আমাদের বাধার মুখে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

অভিযোগের বিষয়ে ডা. নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি। আমি কেন আমার প্রতিষ্ঠান দখল করতে যাব? আমার লোকজন নিয়ে মিটিং করতে গিয়েছিলাম। বরং তারাই আমাদের পুলিশ দিয়ে হয়রানি করছে।’

অঙ্গীকারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওরা জোরপূর্বক আমার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছে। আমি বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় লড়ব। বর্তমানে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে যারা পরিচয় দিচ্ছেন, তারা অবৈধ। আমি বোর্ড করেছি, এটা নিবন্ধিত। আমার ট্রাস্টি বোর্ড বৈধ। আমি কোনো দুর্নীতি করিনি, বরং তারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।’

আশুলিয়া থানার ওসি আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, এক পক্ষের হামলার অভিযোগ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আনে। পাঁচজনকে আটক করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে হামলায় সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
 

আরও পড়ুন

×