সাগরে মিলছে না মাছ কষ্টে মৎস্যজীবী

সাগরে পর্যাপ্ত মাছ ধরা না পড়ায় খাঁ-খাঁ করছে সুন্দরবনের চরে শুঁটকির চাতাল সমকাল
মনিরুল হায়দার ইকবাল, মোংলা (বাগেরহাট)
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:১৬
৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে সাগরে মাছের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মোংলার আলোরকোলের ব্যবসায়ী সুধাংশু বিশ্বাস ও শেলারচরের সেকেন্দার আলী। তবে চলতি বছরের মতো এত মাছ সংকট কখনও দেখেননি তারা। দুই ব্যবসায়ীর ভাষ্য, এ অবস্থা চলতে থাকলে পুঁজি উঠবে না। অনেকে সুদে ঋণ আর মহাজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে মাছ আহরণ করতে এসেছেন। এবার সাগরে পর্যাপ্ত মাছ না পেলে তারা সে টাকা কীভাবে শোধ করবেন, তা নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় মাস ধরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। দুবলার চর এলাকায় গত নভেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া মৎস্য আহরণ মৌসুমে মৎস্যজীবী ও জেলেরা পর্যাপ্ত মাছ পাননি। এতে হতাশা ও উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন তারা। বন বিভাগের রাজস্ব আয়েও বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জেলেরা পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় বন বিভাগের রাজস্ব ঘাটতির শঙ্কা রয়েছে বলে স্বীকার করেন দুবলা ফরেস্ট টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরেস্ট রেঞ্জার মো. খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, বর্তমানে মৌসুমি বায়ুর তোড়ে সমুদ্র উত্তাল রয়েছে। অন্যবার এ সময়ে প্রায় ২ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। এবার তা কমে ১ কোটি টাকার কাছাকাছি নেমে এসেছে।
জেলে, মৎস্যজীবী ও বন বিভাগ থেকে জানা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও নভেম্বর মাস থেকে দুবলার চর এলাকায় শুরু হয়েছে পাঁচ মাসব্যাপী শীতকালীন মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ মৌসুম। এ সময় জেলে ও মৎস্যজীবীরা নৌকা ও ট্রলারে করে সাগর থেকে মাছ আহরণের পর সুন্দরবনের বিভিন্ন চরে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করেন। এ সময় কোটি কোটি টাকা লগ্নি করেন হাজার হাজার জেলে ও মৎস্যজীবী।
মোংলার সোনাইলতলা এলাকার জেলে সাইফুল সরদার (৪০) ও মোতালেব গাজী (৫০)। দু’জনই মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে দুবলার চরে গেছেন মাছ ধরতে। আলোরকোলের চরে অস্থায়ী বসতি স্থাপন করে মাছ আহরণ শুরু করেছেন। কিন্তু দু’মাসে চাহিদামতো মাছ পাননি। অনেক দিন খালি ট্রলার নিয়ে ফিরতে হচ্ছে। তারা বলেন, গত বছর মৌসুমের প্রথম দু’মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকার মাছ ধরেছেন। এবার একই সময়ে ৩-৪ লাখ টাকার মাছ পেয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি থাকায় এ অবস্থা হয়েছে। তাদের মতো প্রায় সব জেলে একই পরিস্থিতিতে পড়েছেন। এ সময় সুন্দরবনের পুরো উপকূলীয় এলাকায় জেলে ও মৎস্যজীবীরা নানা কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত সময় পার করেন। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। জেলে ও মৎস্যজীবীরা মাছ সংকটে বিপদে পড়েছেন। দেড় মাসে তিন ‘গোণে’র (অমাবস্যা ও পূর্ণিমা) সময়ে সাগরে জাল ফেলে মাছ পেয়েছেন কম। এতে জেলে ও মহাজনরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
দুবলার চরের আলোরকোলে রামপাল জেলে সমিতির সভাপতি মোতাসিম ফরাজী বলেন, দেড় মাসে তিন গোণ ধরে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। দুই থেকে তিন ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে সাগরের গভীরে গিয়ে জাল ফেলেও পাওয়া যায় না মাছ। তেল খরচের টাকাও উঠছে না। ২৫-৩০ বছরের মধ্যে দুবলার চরে শুঁটকি তৈরির কাজে যুক্ত জেলেরা এমন সংকটে পড়েনি বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, গত অমাবস্যার সময় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয় ঘূর্ণিঝড় ‘ফিনজাল’। আর বর্তমানে পূর্ণিমার গোণে চলমান লঘুচাপ ও বৃষ্টির কারণে সমুদ্র উত্তাল রয়েছে। এতে মাছ শিকারে বেগ পেতে হচ্ছে মৎস্যজীবীদের। দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদের ভাষ্য, গত তিন গোণে সাগরে পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় জেলে ও মহাজনরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। বিভিন্ন চরের চাতাল ও মাচা মাছের অভাবে খাঁ খাঁ করছে।
সাগরে জেলেদের জালে মাছ ধরা পড়া সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বিষয় উল্লেখ করে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী নূরুল করিম বলেন, এখানে বন বিভাগের কিছু করার নেই। এ মৌসুমে জেলেরা পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় বন বিভাগের টার্গেট রাজস্ব আয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এখন সাগরে মাছ কম ধরা পড়লেও সামনে এ সংকট কেটে যাবে বলে মনে করেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল। তিনি বলেন, বিস্তারিত জানতে মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা শিগগির সমুদ্র এলাকা পরিদর্শন করবেন।
ময়মনসিংহ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মৎস্য গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, জলবায়ুর তারতম্যের কারণে সাময়িকভাবে মাছ নাও ধরা পড়তে পারে। আরও কিছুদিন না দেখে সঠিক মন্তব্য করা যাবে না।
মোংলা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ হারুন অর রশিদ বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সাগরে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় বা বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টির শঙ্কা নেই। এ সময় আবহাওয়া ও আকাশ অনেকটা পরিষ্কার থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
- বিষয় :
- মাছ ধরা