ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সরেজমিন: সুনামগঞ্জ

হাওরের বাঁধ অক্ষত, তবুও লুটপাটের ক্ষেত্র প্রস্তুত

অধিক ব্যয়ে প্রকল্প, অনিয়ম আগের মতোই

হাওরের বাঁধ অক্ষত, তবুও লুটপাটের ক্ষেত্র প্রস্তুত

সুনামগঞ্জের হালি হাওরের বদরপুর অংশের অক্ষত একটি বাঁধ। এ রকম অনেক বাঁধ অক্ষত আছে, তবুও বরাদ্দ বেড়েছে। সম্প্রতি তোলা সমকাল

 পঙ্কজ দে, সুনামগঞ্জ

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:১১ | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:০৭

পুরোনো আদলেই বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে সুনামগঞ্জে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ। চলতি বছর জেলার ৪৭টি হাওরে ক্লোজার বা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) কমলেও খরচ আরও বেশি লাগবে বলে দেখানো হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ কাগজে-ফাইলে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত পিআইসি গঠনের কাজই বাকি। বিলম্বে পিআইসি গঠন ও এর প্রক্রিয়া নিয়ে লুকোচুরি খেলা আগের মতোই চলছে– এমন দাবি কৃষকদের।

২০১৭ সালের প্রলয়ংকরী হাওর বিপর্যয়ের পর বিগত সাত বছর সরকারদলীয় লোকজন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে হাওর রক্ষা বাঁধে নামে-বেনামে বরাদ্দ তছরুপ করেছেন, এমন অভিযোগ অনেক দিনের। দায়িত্বশীলদের যোগসাজশে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা 
না করে হাওরের সর্বনাশ ডেকে এনেছে রাজনৈতিক মধ্যস্বত্বভোগীরা। এ বছরও সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, গতবারের তুলনায় এ বছর ক্লোজার (বিপজ্জনক ভাঙা) কমেছে, পুরোনো মাটিতে অক্ষত আছে অনেক বাঁধ। তার পরও হাওর রক্ষা বাঁধে প্রাক্কলিত ব্যয় কমছে না। বরং সবকিছু চলছে পুরোনো ধাঁচেই। এবার খরচ আরও বেশি লাগবে– দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া নীতিমালা মেনে যথাসময়ে পিআইসি গঠন এবং কাজ শুরু নিয়ে শঙ্কা আছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় পট পরিবর্তন হলেও অনিয়ম-লুটপাটের চিত্র আগের মতোই রয়েছে।

গত শুক্রবার হালি, শনি ও মহালিয়া হাওর ঘুরে দেখা যায়, এ বছর বাঁধ সংস্কার ও মেরামতে যে পরিমাণ বরাদ্দ হয়েছে, তাতে লুটপাটের ক্ষেত্র প্রস্তুত। হালি হাওরের বদরপুর থেকে হাওড়িয়া আলীপুর অংশের অধিকাংশ স্থানে পুরোনো মাটি রয়ে গেছে। ঘনিয়ার বিলসংলগ্ন বাঁধে বরাবরের মতো এ বছরও একটি বড় ভাঙন থাকলেও হাওড়িয়া আলীপুর স্কুলের কাছে গত বছরের বড় ভাঙনটি নেই। শনির হাওরের নান্টুখালী বাঁধের পুঁটিচূড়া বিলসংলগ্ন অংশে একটি বড় ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরও তার আশপাশে এমন একটি ভাঙন ছিল। তবে এ হাওরের বিপজ্জনক ভাঙন লালুর গোয়ালা (রাজধরপুর গ্রামের বিপরীত পাড়) অক্ষত থাকলেও স্লুইসগেট-সংলগ্ন নতুন অংশে ক্লোজারের সৃষ্টি হয়েছে। একই হাওরের জামালগঞ্জ অংশের অন্য বাঁধগুলো অনেকটা অক্ষত। বেহেলি বাজারের উত্তরপাড়ের শনির হাওর অংশে প্রতিবছর বাঁধ হয়, সেখানে ছোটখাটো একটি ভাঙন আছে। বেহেলী বাজার থেকে বদরপুরমুখী কছমার হাওর অংশে একটি ক্লোজার আছে। এখানে প্রতিবছরই বাঁধ হয় এবং ছোট-বড় একটি ক্লোজারও থাকে, আগেও ছিল।

অপরদিকে, হালি হাওরের মামুদপুর গ্রামের সন্নিকটে বাঁধটি (পানি নিষ্কাশন ও প্রবেশের সুবিধার্থে কেটে দেওয়া) পিআইসির মাধ্যমে প্রতিবছর সংস্কার করা হয়। এ বছর এখানকার ভাঙনটি ছোট। এ জন্য বেশি মাটির প্রয়োজন হবে না। মামুদপুরের সেই ভাঙা থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত বাঁধের অনেকাংশে গত বছরের মাটি ঠিকঠাক আছে। অন্য পাড়ে মহালিয়া হাওরের হিজলা গ্রামের উত্তরাংশে বরাবরের মতো এ বছরও ক্লোজার আছে। তবে এ হাওরের ঝালোখালী অংশে (মদনাকান্দি গ্রামের পশ্চিমে) গত বছর অতিঝুঁকিপূর্ণ যে ক্লোজার ছিল, এ বছর সেটি নেই। এ ছাড়া এখানকার অন্য বাঁধগুলো স্থায়ী বাঁধের মতো হয়ে আছে।

এদিকে, মদনাকান্দি থেকে আছানপুর হালি হাওর অংশে কোনো ভাঙন নেই। ২০২২ সালে আছানপুর প্রাইমারি স্কুলের সম্মুখস্থলের বাঁধ ভেঙে হাওরডুবির যে ঘটনা ঘটেছিল, এ বছর সেই বাঁধ পুরোপুরি অক্ষত রয়েছে। আছানপুর থেকে সুন্দরপুর-কালীবাড়ি হয়ে উলুকান্দি-যতীন্দ্রপুরমুখী ডাকাতখালী বাঁধ পর্যন্ত কোনো ভাঙনের দেখা মেলেনি। তবে উলুকান্দি-যতীন্দ্রপুর গ্রামের আশপাশে গত বছরের মতো এ বছরও ছোটখাটো তিনটি ভাঙন রয়েছে। এ ছাড়া জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সুরমা নদীঘেঁষা পুরোনো ভাঙনটি এবারও আছে। সবকিছু মিলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মেরামতকৃত ছোট-বড় ভাঙনের তুলনায় এ বছর ক্লোজারের সংখ্যা কমলেও বরাদ্দ কমেনি।

গত কয়েক বছরের পিআইসির তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে জামালগঞ্জের ছোট-বড় ছয়টি হাওরের ৪৪টি পিআইসিতে বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি ৯১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। ২০২১-২২ মৌসুমে কয়েকবার বন্যার পরও আগের বছর থেকে ৮টি পিআইসি কমে ৩৬টি প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি ২২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬১টি পিআইসিতে বরাদ্দ ছিল ৯ কোটিরও বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৪টি পিআইসির বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে চারটি পিআইসি কমলেও ৪০টির অনুকূলে সম্ভাব্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। প্রতিবছর বাঁধের ওপর বাঁধ দেওয়া হলেও বরাদ্দ কমেনি।

হাওড়িয়া আলীপুর গ্রামের কৃষক মিজান হোসেন নিকেল বলেন, আমাদের গ্রামের আশপাশে যে বাঁধ আছে, সেগুলোতে বেশি মাটির দরকার নেই। শুধু ভাঙাগুলোতেই মাটি লাগবে। বছরে বছরে বরাদ্দ বাড়ে, তাতে কৃষকের বদলে লাভবান হয় অন্যরা। বিগত দিনে এক দল খেয়েছে, এখন আরেকপক্ষ সক্রিয়, পুরোনোরা ভেতরে ভেতরে এদের সঙ্গে আছে। যদি প্রকৃত কৃষকদের পিআইসি দেওয়া হয়, তাহলে তারা নিজের তাগিদেই বাঁধে ভালো কাজ করবে। বাঁধও টেকসই হবে।

মামুদপুর ভাঙনস্থলে দাঁড়িয়ে ওই গ্রামের কৃষক আবদুল মমিন বলেন, ‘জায়গায় জায়গায় মাডি (মাটি) আছে। সারা ভাইস্যা (বর্ষা) ওই বাঁধ দিয়া হাইট্যা (হেঁটে) যাওন গেছে। অনেক বাঁধেই যে পরিমাণ মাডি লাগার কথা, এইবার সেই পরিমাণ মাডি লাগতো নায়। বরাদ্দ কম হইলেই চলব।’ ভাঙা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই ভাঙাতে যদি একটা স্লুইসগেট হয়, তাইলে প্রতিবছর সরকারের লাখ লাখ ট্যাকা গচ্ছা যাইতো নায়।’

এ ব্যাপারে জামালগঞ্জের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী উপজেলা হাওর রক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সদস্য আরিফ বাদশা বলেন, শনিবারের সভায় দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বাঁধের বিষয়টি যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি তেমন বোঝা যায়নি। কাজ শুরু হলে বোঝা যাবে কোথায় কী গলদ আছে। বিগত সময়ে দলীয়করণ ও লুটপাট হয়েছে। এ বছর সে রকম হলে আমি কৃষকের পক্ষে অবস্থান নেব।

জামালগঞ্জ উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) শাখা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জনি বাড়তি বরাদ্দের বিষয়ে বলেন, পিআইসি কিংবা বরাদ্দ কোনোটাই নির্ধারিত নয়। কাজের ওপর নির্ভর করবে বরাদ্দ। এমনও হতে পারে, ৩০টি পিআইসিতে ৮ কোটি টাকাও বরাদ্দ হতে পারে। বরাদ্দের বিষয়টি আসলে ক্ষতিগ্রস্ত কতটুকু হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে। গতবার যে জায়গায় ছিল, এবার আরেক জায়গায় হয়েছে। প্রি-ওয়ার্ক অনুযায়ী যেখানে যেটা আছে, বরাদ্দও সে রকম হয়েছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীলরা জানান, গেল বছর হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ করার সময় ক্লোজার ছিল ১৬৯টি, প্রকল্প ছিল ৭৩৪। এবার ক্লোজার কমেছে। সব মিলিয়ে ক্লোজার চিহ্নিত করা হয়েছে ১০৫টি। গত বছর বাঁধের কাজের চূড়ান্ত বিল হয়েছিল ১০২ কোটি টাকা। এ বছর প্রাক্কলিত বাজেট পাঠানো হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ ইমদাদুল হক বলেন, জরিপ অনুযায়ী যে প্রাক্কলিত ব্যয় এসেছে, সেটিই আমরা ঊর্ধ্বতনদের পাঠিয়েছি। 

একই কথা বললেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মামুন হাওলাদার। তিনি জানালেন, ৬৭৫টি প্রকল্পের মধ্যে ৪৪৯টির পিআইসি গঠনের কাজ শেষ করেছে। বাকিগুলোও গঠনের কাজ চলমান। সবকিছু নীতিমালা অনুসারে হচ্ছে দাবি তাঁর।

জেলা হাওর রক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া সমকালকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে আমি জানতে চাইব, কেন প্রাক্কলিত ব্যয় বেড়ে গেল।

 

আরও পড়ুন

×