জীবিকা সংকটের শঙ্কা ৫ শতাধিক পরিবারে

আজমিরীগঞ্জে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য সংগৃহীত মাছ প্রক্রিয়াজাত করছেন স্থানীয়রা সমকাল
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৪৬
পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়ভাবে শুঁটকি উৎপাদনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চলের শুঁটকি পল্লিগুলো। তবে সময়ের সঙ্গে সেই কর্মব্যস্ততা কমে আসছে। ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে শুঁটকি উৎপাদনকারী পরিবারের সংখ্যা। সেই সঙ্গে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প।
এই অঞ্চলের উৎপাদিত শুঁটকির সুনাম দেশের সীমানা পেরিয়ে আরও আগেই ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে। যার কারণে হবিগঞ্জ জেলায় উৎপাদিত শুঁটকির উল্লেখযোগ্য একটি বাজার সৃষ্টি হয় দেশের বাইরে। তবে সম্ভাবনা থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এই শিল্পকে রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত করা যায়নি এখনও। সেই সঙ্গে হবিগঞ্জের শুঁটকির যে চাহিদা বিদেশের বাজারে সৃষ্টি হয়েছিল, তা ধরে রাখা যায়নি।
শুধু তাই নয়, দেশের বাজারেও এই অঞ্চলের শুঁটকির ব্যাপক চাহিদা থাকলেও সেভাবে উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না স্থানীয় শুঁটকি উৎপাদনকারীদের পক্ষে; যার অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদনকারীদের অর্থ সংকট, শুঁটকি তৈরি করে এমন পরিবারগুলোকে শুঁটকি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে কোনো পক্ষ থেকে সহায়তা না দেওয়া এবং সর্বোপরি হাওরে শুঁটকি উৎপাদনের উপযুক্ত দেশীয় প্রজাতির মাছের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া। এ ছাড়া দেশ-বিদেশে বড় পরিসরে দেশীয় শুঁটকির সম্ভাব্য বাজার সৃষ্টির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ না থাকায় উৎপাদনকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
শুঁটকি উৎপাদনে স্থানীয় পরিবারগুলোকে অনুপ্রাণিত করতে না পারা এবং এ পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় নতুন প্রজন্মকে দূরে রাখতে চাচ্ছে তাদের পরিবার। উৎপাদনকারী পরিবারের সংখ্যা কমে যাওয়ায় শুঁটকির উৎপাদনেও ভাটা পড়েছে।
হবিগঞ্জের শুঁটকি শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে শঙ্কিত পরিবারগুলোর অনেক সদস্য এরই মধ্যে এ পেশা ছেড়ে অন্য খাতে ঝুঁকেছেন। শুঁটকির উৎপাদন কমতে শুরু করায় অনেক পরিবার বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে আগ্রহ কম এ পেশায় আসার ব্যাপারে। ফলে তারা এখন অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন।
শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলছেন, হাওরে পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে শুঁটকি উৎপাদনের প্রধান উপকরণে টান পড়েছে। এ পেশায় জড়িতরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় তাদের উন্নতি হচ্ছে না। বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে যে পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন করা দরকার, তা সম্ভব হচ্ছে না। এত বড় পরিসরে উৎপাদন ও বিনিয়োগের জন্য যে আর্থিক সামর্থ্য দরকার, তা তাদের অধিকাংশেরই নেই। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করা গেলে বিদেশের বাজারে হবিগঞ্জের শুঁটকি নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারত। জেলার আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, নবীগঞ্জ, বাহুবল ও লাখাই উপজেলার অন্তত ৫ শতাধিক পরিবার শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এখানকার উৎপাদিত শুঁটকিতে কোনো ধরনের রাসায়নিক বা অস্বাস্থ্যকর কিছু মেশানো হয় না। এতে করে এসব শুঁটকি স্বাদ ও মানে অনেক উন্নত, চাহিদাও বেশি।
শুঁটকি উৎপাদনকারী পরিবারের একাধিক সদস্য জানান, এ বছর শুঁটকি উৎপাদনকারীরা হতাশ। নদনদী ও হাওরের পানি শুকিয়ে গেলেও পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। দেশি প্রজাতির মাছের সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, লাভের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং নতুন বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা না থাকার কারণে শুঁটকি উৎপাদনে ভাটা পড়েছে। এদিকে দেশের বিভিন্ন বাজারে শুঁটকির চাহিদা থাকলেও উৎপাদন কমে গেছে।
স্থানীয় জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, একটা সময় এই জেলার সহস্রাধিক মানুষ শুঁটকি উৎপাদন করতেন, যা বর্তমানে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে জেলায় শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৬২০ টন। এবার সেই লক্ষ্যমাত্রার বেশি উৎপাদন হতে পারে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা। তবে দিন দিন মাছের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং এ পেশার প্রতি স্থানীয়রা আগ্রহ হারাতে থাকায় শুঁটকি উৎপাদন শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে।
রহিমা খাতুন নামে এক নারী জানান, জীবনের বেশির ভাগ সময় শুঁটকি উৎপাদন করে কাটিয়েছেন। তবে এখন শেষে বয়সে এসে তা করতে পারছেন না। পুরুষরা হাওর থেকে মাছ ধরে এনে দিলেও মাছ কাটা, ধোয়া ও শুঁটকি করার বেশির ভাগ কাজই করেন নারীরা। এই গোষ্ঠীর জন্য সরকারের দিক থেকে কোনো সহযোগিতা না থাকায় হতাশ তারা। এখন মাছের মজুত কম। তাই শুঁটকির উৎপাদন কমে গেছে।
মিজানুর রহমান নামে এক জেলে জানান, হাওরে দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। যে মাছ পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম অনেক বেশি। তা দিয়ে শুঁটকি তৈরি করে পোষাতে পারছেন না উৎপাদনকারীরা। লাভ কম হওয়ায় শুঁটকি উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই। অধির দাস নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, একটা সময় এই এলাকার শুঁটকি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ যেত। এখন তা অনেকটাই কমে গেছে। শুঁটকি উৎপাদনে সব প্রতিকূলতা কাটাতে হাওরে দেশি মাছের পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বিশেষভাবে নজর রাখার আহ্বান জানান তিনি।
হবিগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান মজুমদার জানান, হবিগঞ্জের শুঁটকির চাহিদা রয়েছে দেশ ও বিদেশে। তাই শুঁটকির উৎপাদন বাড়াতে কাজ করছে মৎস্য বিভাগ। এরই মধ্যে শুঁটকি উৎপাদনকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া হাওরে দেশি মাছের পরিমাণ বাড়াতে করণীয় নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। প্রতিকূলতা কাটিয়ে
শুঁটকি উৎপাদন শিল্পে সুদিন ফিরে আসবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
- বিষয় :
- মাছ ধরা