ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

‘বিশেষ খরচায়’ পল্লী বিদ্যুতের সেবা

‘বিশেষ খরচায়’ পল্লী বিদ্যুতের সেবা

ফাইল ছবি

আনছার আলী, মধুপুর (টাঙ্গাইল)

প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:৩২

এক জায়গার সেচ মিটার অন্যত্র চালানো, অনুমোদনহীন লাইন নির্মাণ, ট্রান্সফরমার পুড়ে গেলে ‘বিশেষ খরচায়’ মুহূর্তের মধ্যে ব্যবস্থা করা করা হয়। লাইসেন্সধারী ওয়্যারিং ইলেকট্রিশিয়ানের কাজকর্মে স্থগিত আদেশ থাকলেও ‘বিশেষ শর্তে’ ওয়্যারিং করার মৌখিক অনুমতি দিয়ে আবার কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়াসহ নানা অভিযোগের পাহাড়। টাকা দিলে মেলে না এমন কোনো কাজ নেই এ অফিসে। বলা হচ্ছে ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মধুপুর জোনাল অফিসের কথা। অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব তথ্য।
অভিযোগ রয়েছে, লাইনম্যান ও কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে বিদ্যুৎ সংযোগের নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মধুপুর জোনাল অফিসে কোনো সেবা নিতে গেলেই গুনতে হয় টাকা। আর টাকা না দিলেই হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়।
চাড়ালজানী পশ্চিম এলাকার টেকিপাড়া এলাকার গ্রাহক আনোয়ার হোসেন জানান, একটি মিটারের জন্য লাইনম্যানের মাধ্যমে অফিসকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন তিনি। মিটার দিয়ে সংযোগও পেয়েছিলেন। কিন্তু অভিযানের সময় কাগজপত্র না দেখাতে পারায় তাঁর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। 
মির্জাবাড়ী এলাকার কৃষক রুবেল একটি সংযোগের জন্য ৩০ হাজার টাকা দিয়ে সম্প্রতি সংযোগ নিয়েছেন। আবার ভবানী টেকি গ্রামের আব্দুল হালিম সরকার নামে এক গ্রাহক সেচ সংযোগ নিয়েছেন। যার মিটার নম্বর ১৮১০৪৪৫ (আরইবি-১০৩৪৩১৬৯৬)। কিন্তু মিটারটি চলছে অন্য ইউনিয়নের ভুটিয়া জিগাতলা এলাকায়। 
জানা গেছে, দায়িত্বশীল এক ব্যক্তি চক্রের সদস্যদের দিয়ে টাকা নিয়ে এমন অসম্ভব কাজ সম্ভব করেছেন। তবে আওয়ামী লীগ নেতা 
হালিম সরকার টাকা দিয়ে কাজটি করার কথা অস্বীকার করেছেন। প্রভাব খাঁটিয়ে কাজটি করেছেন বলে মন্তব্য তাঁর।
মির্জাবাড়ী ইউনিয়নের পালবাড়ী গ্রামের জোবায়ের হোসেন জোয়ার্দ্দার নামে একজন ৬০ হাজার টাকায় ‘অফিস ম্যানেজ’ করে নিজের সুবিধামতো কাজ বাগিয়েছেন। সদ্য বিদায়ী কর্মকর্তা বিদায়ের ঠিক আগ মুহূর্তে অফিসকে আড়াল করে পালবাড়ী মোড়ে খুঁটি স্থানান্তরের ব্যবস্থা করেছেন। বাড়তি খুঁটি ব্যবহার করে স্থানীয় একটি টাওয়ারের সংযোগ লাইনে এমন পরিবর্তন করা হয়েছে।
মধুপুর শহরের চৌধুরী মার্কেটের তিন ফেজের একটি ট্রান্সফরমার সম্প্রতি পুড়ে যায়। পরে বিশেষ সুবিধা নিয়ে তিনটি মিটার দিয়ে লাইন চালু করে একটি চক্র। টাকার অঙ্ক না জানালেও মার্কেটের এক গ্রাহক ঘুষ প্রদানের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি লাইন সংযোগে লড, টেকিং সিট, ম্যাপের জন্য জেনারেল ম্যানেজারের (জিএম) অনুমোদন লাগে। আর সার্ভিস ড্রপ তারে পুল টু পুলের দূরত্ব ১৫০ ফুটের মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু তার বাইরে অতিরিক্ত সার্ভিস ড্রপ তার (ডি-১২) দিয়ে সংযোগ দেওয়ার নজির আছে। পীরগাছা ফকিরের মোড়ে সম্প্রতি টাকার বিনিময়ে এমন সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আতিকুর ও আরিফুরের বাড়িতেও দেওয়া হয়েছে এমন সংযোগ।
ঠিকাদারের লোক দিয়ে পৃথক লাইনের কাজটি করা হয়েছে। মির্জাবাড়ী বাজারের কাছেই ভাইঘাট যাওয়ার পথে একটি দ্বিতল ভবনে লাইন দেওয়ার আয়োজন চলছে। বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, এমন কাজের উদাহরণ আরও আছে।
গত বছরের ২৮ আগস্ট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেন মিনহাজ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। তাঁর অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, সেচ ও শিল্প শ্রেণির প্রতিটি সংযোগের ট্রান্সফরমার জন্য গ্রাহকপ্রতি ২০ হাজার টাকা উৎকোচ দাবি করা হয়। না পেলে তিনি গ্রাহককে অফিসিয়ালি সুবিধা না দিয়ে ট্রান্সফরমার বাইরে থেকে ক্রয় করান। আবাসিক গ্রাহকের আবেদনপ্রতি ২০০ টাকা না দিলে আবেদন বাতিল করেন। জমা দেওয়া জমির পরচা সঠিক নেই বলে বাতিল করা আবেদন টাকা দিলে দ্বিতীয়বার বৈধ হওয়ার ঘটনাও আছে। মিনহাজ উদ্দিনের অভিযোগ, এজিএম তাঁর সিন্ডিকেটের দালাল দিয়ে বিদ্যুৎ বিল বকেয়ার ডিসি করান। পরে ডিসি আরসি করিয়ে সংযোগ দিয়ে তার ফি অফিসে জমা না দিয়ে ভাগবাটোয়ার করেন।
একাধিক অভিযোগে লাইসেন্স স্থগিত হওয়া ইলেকট্রিশিয়ান আশরাফুল জানান, প্রতিপক্ষের অভিযোগে ও অফিসিয়াল একজনের বিরাগভাজন হওয়ায় সাজানো অভিযোগে তাঁর লাইসেন্স স্থগিত হয়। এজিএম মুশফিকুর রহমান স্থগিত আদেশ প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। ২০ হাজার দিয়ে ২০২৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে কাজের সুযোগ পেলেও আবার সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই মাসে ৩০-৩৫টি ওয়্যারিং করেছেন তিনি। মিটারও লেগেছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এজিএম মুশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, এসব অভিযোগ সঠিক নয়। তাদেরকেই জিজ্ঞাস করেন, কারা সুবিধা নিয়েছে।
ডিজিএম নূরুল আমিনের ভাষ্য, দাপ্তরিক অনুমতি ছাড়া এক স্থানের মিটার অন্য স্থানে ব্যবহার করা যায় না। লাইসেন্সধারী ইলেকটিশিয়ানের লাইসেন্স স্থগিত হলে তাঁর কাজ করার সুযোগ 
নেই। টাকা দিয়ে সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম শহীদ উদ্দিন বলেন, অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করতে গেলে অভিযোগকারীরা প্রমাণ হাজির করতে পারেন না। ফলে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না। সম্প্রতি একটি অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি জানান, একজন কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×