ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

পাহাড়ে পানির তীব্র সংকট, কষ্ট বেড়েছে কয়েক গুণ

পাহাড়ে পানির তীব্র সংকট, কষ্ট বেড়েছে কয়েক গুণ

গ্রামে কোনো নলকূপে পানি ওঠে না। ঝিরি-ঝর্ণাও শুকনা। দূরের এলাকা থেকে পানি সংগ্রহ করে ফিরছেন এক নারী। মঙ্গলবার রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার উপর চেলাছড়া গ্রামে সমকাল

 সত্রং চাকমা, রাঙামাটি

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫ | ০১:০৫ | আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫ | ০৭:৫৩

ভাদিবি চাকমা। বয়স চল্লিশের ঘরে। রাঙামাটি সদর উপজেলার সাপছড়ি যৌথখামার গ্রামে তাঁর বাস। প্রতিদিন তাঁর কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করতে হয় এক কলসি খাবার পানির জন্য। এর বেশি নিতে হলে পুরোটা দিনই নষ্ট হয়।

শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই ভাদিবির মতো পানির সংকটে পড়েছেন পুরো গ্রামের মানুষ। শুধু সুপেয় পানি নয়, নিত্যব্যবহার্য পানিরও অভাব। শুধু এ গ্রামে নয়, কাউখালী উপজেলার উপর চেলাছড়া, কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গা ইউনিয়নের দেবতাছড়িসহ রাঙামাটির ১০ উপজেলায় বহু গ্রামের মানুষ এমন দুর্ভোগে রয়েছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পানির স্তর কোনো কোনো স্থানে ৩ থেকে ৭ ফুট নেমে গেছে। নলকূপ দিয়ে পানি আসছে না। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বনে গাছ না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে ছড়া, ঝিরিগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০০ ফুট ওপরে যৌথখামার গ্রামটির অবস্থান। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের ৫২টি পরিবারের পানির জন্য একমাত্র ভরসা ফুরামোন পাহাড়ের পাদদেশের পাইপলাইন। গ্ল্যাভিটি ফ্লো সিস্টেমের (জিএফএস) মাধ্যমে পাইপলাইনটিতে পানি আসে। সেখানে এক কলসি পানির জন্য লম্বা লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছেন গ্রামের মানুষ। 

একই অবস্থা কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের দুর্গম উপর চেলাছড়া গ্রামে। এ গ্রামের ৪২টি পরিবারের পানির জন্য ভরসা কুয়ার পানি ও রিংওয়েল। পানির স্তর কমে যাওয়ায় কুয়া খুঁড়েও পানির নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। রিংওয়েলে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে অল্প অল্প করে যতটুকু পানি মিলছে, তা দিয়েই খাবার ও অন্যান্য কাজ চালাতে হচ্ছে গ্রামবাসীকে। 

কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের দেবতাছড়ি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সেখানেও পানির সংকট। গ্রামের লোকজনকে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঝিরি বা ঝর্ণা থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। 

রাঙামাটির ১০ উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের গ্রামগুলোতেও একই পরিস্থিতি। এর মধ্যে বরকল, লংগদু, বাঘাইছড়ির সাজেক, নানিয়ারচর, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকায় গিয়ে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা যায়।   

সাপছড়ি যৌথখামার গ্রামের আলো রানী চাকমা সমকালকে বলেন, এক কলসি পানি আনতে প্রচুর সময় ব্যয় হচ্ছে। সংসারের বাকি কাজগুলো করা যাচ্ছে না। বাইরে থেকে কাজ করে আসার পর গোসল দূরের কথা, অনেক সময় হাতমুখ ধোয়ার পানিও থাকে না। 

উপর চেলাছড়া গ্রামের সূচনা দেবী চাকমা, পূর্ণিমা চাকমা, পুতুল সোনা চাকমা, বুদ্ধ চাকমাও একই কথা বললেন। তারা জানান, ছড়াগুলো শুকিয়ে গেলে পানির কষ্ট বেড়ে যায়। কুয়া খুঁড়েও পানি পাওয়া যায় না। 

দেবতাছড়ি গ্রামের জয়ন্ত তঞ্চংগ্যা জানান, বৈশাখ মাস পর্ষন্ত পানির সংকটে ভুগতে হয়। অনেক দূরে পাহাড়ের নিচে কুয়া খুঁড়ে পানি আনতে হয়। 
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নিখিল চাকমা বলেন, কম বৃষ্টিপাত ও ইকোসিস্টেম পরিবর্তন হয়েছে। আগে যে পরিবেশ ও বনজঙ্গল ছিল, তা আর নেই। ঝিরির পাশে যেসব গাছ ছিল, তাও নেই। গাছগুলো পানি ধরে রাখত। সে জন্য পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। 

রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া পাহাড়ে পানির সংকট মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজ করছে বলে জানান। তিনি বলেন, পানির চাহিদা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কয়েকটি উপজেলায় পানির সংকট লক্ষ্য করছি। জেলার ৫০টি ইউনিয়নে পানির উৎস স্থাপনের কাজ চলছে। এসব বাস্তবায়ন হলে এলাকার লোকজন ও পর্যটকরা পানির সুবিধা পাবেন। 

পরাগ বড়ুয়া বলেন, পাহাড়ে প্রতি বছর দুই থেকে তিন ফুট পানির স্তর কমে যাচ্ছে। জেলার প্রতিটি উপজেলায় পানির স্তর পর্যবেক্ষণ নলকূপ দিয়ে স্তর মাপা হয়। অন্য উপজেলায় পানির স্তর আরও অনেক কমে যেতে পারে। জুরাছড়িতে দেখা গেছে, পানির স্তর সাত ফুট নেমে গেছে। 

আরও পড়ুন

×