ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস

ফসলের জমিতে তামাকের আগ্রাসন

ফসলের জমিতে তামাকের আগ্রাসন

কুষ্টিয়ায় ফসলি জমিতে এখন তামাকের রাজত্ব, হুমকিতে পরিবেশ। ছবি: ফেব্রুয়ারিতে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় তোলা

এস. এম. সরোয়ার পারভেজ

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫ | ১৯:২০ | আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ | ১৯:৩৫

 

একসময় কুষ্টিয়ার মাঠ ছিল ধান, গম, ভুট্টা আর নানা সবজির সবুজে ছাওয়া। এখন সে জমিগুলোতে সারি সারি তামাক গাছ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোনো নতুন সবুজ বিপ্লব। কিন্তু এই ‘সবুজ’ যেন এক বিষাক্ত আশ্রয়। জেলার দৌলতপুর, মিরপুর, ভেড়ামারা, খোকসা ও কুমারখালী উপজেলায় বাড়ছে তামাক চাষ। অর্থনৈতিক লাভের আশায় কৃষকরা দিন দিন ঝুঁকছেন এই ফসলের দিকে।
বিকল্প খাদ্য ফসল উৎপাদন ও বিপণন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই ও পুষ্টিকর ফসল চাষে তামাক চাষিদের উৎসাহিত করতে বিশ্বজুড়ে তামাক মুক্ত দিবস পালিত হচ্ছে আজ। ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’– এই প্রতিপাদ্য নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। তামাক উৎপাদনে কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচনও এবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের একটি অন্যতম লক্ষ্য। 

তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভন, আগাম টাকা, কৃষি উপকরণ এবং নিয়মিত ‘সাপোর্ট’ কৃষকদের উৎসাহিত করছে লাভের ফাঁদে পা দিতে। কিন্তু এ লাভ যে কতটা ক্ষণস্থায়ী, তা তুলে ধরেছেন কৃষি ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিস্তৃতভাবে তামাক চাষের প্রভাব পড়ছে সমাজেও। অভিভাবকদের অভিযোগ, তামাকজাত দ্রব্য বাজারে সহজলভ্য হওয়ায় তরুণদের ধূমপানের প্রবণতা বেড়েছে। এই বিষাক্ত অভ্যাস এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা জিইয়ে রাখছে। পরিবেশগত দিক থেকেও তামাক একটি বিপজ্জনক ফসল। তামাক শুকাতে বনজ কাঠ ব্যবহারের ফলে বন উজাড় হচ্ছে। জমির জৈব গুণ নষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

কুষ্টিয়ার  দৌলতপুরে একটি বাড়িতে চলছে তামাক শুকানোর কাজ

বাংলাদেশের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কম হলেও তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। বিশ্বের মোট তামাকের ১.৩ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। তামাক চাষের কারণে খাদ্য ফসলের জমি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে রবি মৌসুমের প্রধান খাদ্য ফসলের মধ্যে বোরো ধান, গম ও আলু অন্যতম এবং এ মৌসুমেই তামাক চাষ হয়ে থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশে তামাকজনিত অসুস্থতায় প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। দেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক।
তামাকের মোহে কৃষকসমাজ আপাতত লাভের মুখ দেখলেও ভবিষ্যৎ যে কতটা অন্ধকার, তার ইঙ্গিত মিলছে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে। কুষ্টিয়ার মতো একটি কৃষিনির্ভর অঞ্চলে এমন বিপজ্জনক চাষাবাদের বিস্তার শুধু অর্থনীতি নয়, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও সমাজের জন্যও এক গভীর হুমকি।

জেলাটির কৃষি কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘তামাক একটি উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন ক্যাশ ক্রপ হলেও এটি মাটি থেকে প্রচুর পুষ্টি শোষণ করে নেয়। ফলে পরবর্তী মৌসুমে ফসল চাষে সমস্যা হয়। আমরা বিভিন্নভাবে কৃষকদের মসলা, সূর্যমুখী, তরমুজ বা রপ্তানিযোগ্য সবজি চাষে উৎসাহ দিচ্ছি। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলোর প্রভাব, আগাম অর্থ ও নিশ্চয়তা কৃষকদের বিকল্প পথ নিতে দিচ্ছে না।’

শুধু জমি নয়, তামাক চাষ হুমকি তৈরি করছে মানবস্বাস্থ্যেও। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের এক চিকিৎসকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, তামাক শুকানোর সময় যে ধোঁয়া ও গন্ধ ছড়ায়, তা শিশুদের শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা তৈরি করে। তা ছাড়া চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক ত্বক ও শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর।

এ বিষয়ে কৃষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। দৌলতপুর উপজেলার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘তামাকে যা লাভ হয়, ধানে তার এক-তৃতীয়াংশও হয় না। কোম্পানির লোকজন মাঠে আসে, সাপোর্ট দেয়, টাকা আগেই দেয়। ফলে তামাকই আমাদের ভরসা।’

একই অভিজ্ঞতা কুষ্টিয়ার মিরপুরের কৃষক রহিম উদ্দিনের। তিনি বলেন, তামাক এখন লাভের ফসল। আগের বছর পাঁচ বিঘা জমিতে তামাক করে যে টাকা পাইছি, ধানে তার অর্ধেকও হইত না।
এবারের তামাক মুক্ত দিবসে 

তামাক ব্যবহারের প্রাদুর্ভাব ও মানব স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব তামাক দিবসে দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান তামাক চাষ পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার আহ্বান এখন সব মহলের।
সাধারণ সম্পাদক সুহৃদ সমাবেশ, কুষ্টিয়া 

আরও পড়ুন

×