ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ

পানি সংকট থেকে প্রাণ সংশয়

সাগর, নদী, মাটি সর্বত্র লবণাক্ততা

পানি সংকট থেকে প্রাণ সংশয়

চালে পড়া বৃষ্টির পানি পাইপ বেয়ে নামে ট্যাঙ্কে। বরগুনার মানুষ এভাবে খাবার পানি মজুত করে সারাবছর পানির প্রয়োজন মেটান। সম্প্রতি পাথরঘাটা থেকে তোলা -সমকাল

 সুমন চৌধুরী, বরিশাল 

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫ | ০১:৩৪ | আপডেট: ২১ জুন ২০২৫ | ০৬:৫৩

বাড়ির আশপাশের নদী-খাল পানিতে ভরপুর। লবণাক্ত হওয়ায় সেই পানি ব্যবহার করা যায় না। গভীর নলকূপের একই অবস্থা। ফলে বরগুনা, পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় সুপেয় পানির সংকট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এ দুর্ভোগ লাঘবে উপকূলের বাসিন্দারা বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি মজুত করেন। সেখানেই হয়েছে হিতে বিপরীত। বরগুনাতে ডেঙ্গুর যে মহামারি চলছে, এর অন্যতম কারণ বৃষ্টির পানি ধরে রাখা– এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বরগুনার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১ থেকে ৫ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার প্লাস্টিক ট্যাঙ্কে বৃষ্টির পানি মজুত রাখা হয়। বর্ষা মৌসুম-পরবর্তী ৩-৪ মাস খাবার ও গৃহস্থালি কাজে এ পানি ব্যবহৃত হয়। সরকারি প্রকল্প ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এ ট্যাঙ্ক সরবরাহ করে। তবে অসচেতনতায় ট্যাঙ্কের মুখ খোলা রাখায় পানিতে এডিস মশার বংশবিস্তারের সুযোগ পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার সমকালকে বলেন, উপকূলের পানিতে লবণাক্ততা বেশি। সুপেয় পানির বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় প্রায় সব পরিবার বৃষ্টির পানি মজুত করে। এতে এডিস মশার লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এসব এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট পুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ফিল্ডার্সের মাধ্যমে শোধন করা হয়। যেটাকে বলা হয় পন্ডস স্যান্ড ফিল্ডার্স (পিএসএফ)। এসব পুকুর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। স্থানীয়ভাবে এগুলো ‘রিজার্ভ পুকুর’ নামে পরিচিত।

বরগুনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, জেলায় সুপেয় পানির উৎসের (গভীর ও অগভীর নলকূপ, পিএসএফ) মোট সংখ্যা ২৭ হাজার ২৪টি। এর মধ্যে সচল ২০ হাজার ৪২৫টি। 

বরগুনার পানি কেমন
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট সর্বশেষ গত মার্চে উপকূলীয় এলাকার নদী ও নলকূপের পানি পরীক্ষা করে। বরগুনা ও পটুয়াখালীর আগুনমুখা, তেঁতুলিয়া, লোহালিয়া, আন্ধারমানিক, পায়রা ও বিষখালী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টের পানিতে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি অতিরিক্ত লবণের অস্তিত্ব মেলে। উপকূলের বিভিন্ন এলাকার নলকূপের পানি পরীক্ষায় পাওয়া যায় একই ফল। সংশ্লিষ্ট এলাকার নদী ও নলকূপের পানি পান এবং ফসলি জমিতে সেচের জন্য ক্ষতিকর বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

জানা গেছে, স্বাভাবিকভাবে পানিতে লবণের মাত্রা ৬০০ পিপিএম (প্রতি মিলিয়ন অংশ) পর্যন্ত থাকলে সেটা খাবার উপযোগী ধরা হয়। কিন্তু বরগুনার পানিতে ৮ হাজার পিপিএম পর্যন্ত লবণের মাত্রা পাওয়া গেছে। 

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বরিশাল আঞ্চলিক দপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএফএম মামুন সমকালকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলের পানি লবণাক্তমুক্ত হওয়ার সুযোগ আর নেই। বরং ভবিষ্যতে লবণের মাত্রা আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। উপকূলবাসীর সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে পানি সংরক্ষণের পুকুর, জলাধার ও শোধনাগার বাড়াতে হবে। অন্তত প্রতি গ্রামে এ রকম একটি সংরক্ষিত পুকুর থাকতে হবে।

বরগুনা জেলা জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী রাইসুল ইসলাম বলেন, জেলার প্রায় সর্বত্র পানিতে লবণাক্ততা অস্বাভাবিক বেশি। কোথাও তার পরিমাণ ৭-৮ হাজার পিপিএম। এ পানি খাবার কিংবা ব্যবহারের উপযোগী নয়। জেলার সর্বত্র নলকূপের পানির রং লালচে। যে কারণে বেশির ভাগ মানুষ গৃহস্থালি কাজে বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল। তারা বড় আকারের ট্যাঙ্কে বৃষ্টির পানি ধরে রাখে। এ প্রকৌশলী বলেন, বৃষ্টির পানি সর্বোচ্চ দু’মাস সংরক্ষণ করা যায়। সম্প্রতি জানতে পেরেছি, তিন দিনের বেশি সংরক্ষিত পানিতে লার্ভা সৃষ্টি হতে পারে। 

পানি সংকটে যা হচ্ছে 
পুরো বরগুনার পানি লবণাক্ত। এর মধ্যে পাথরঘাটা ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া আরও ব্যতিক্রম। এ দুই উপজেলায় নলকূপই বসানো যায় না। ৩০ ফুট গভীরে গেলে পাথরে আটকে যায়। বরগুনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, বরগুনা সদর, পাথরঘাটা ও বামনার একাংশে গভীর নলকূপ বসানো যায় না। পাথরঘাটায় ১২শ থেকে ১৩শ ফুট গভীরে গিয়েও পানির স্তর পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, এলাকায় সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কৌশল নেওয়া হয়েছে। টিনের চালার নিচে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার প্লাস্টিক ট্যাঙ্ক স্থাপন করে পানি সংরক্ষণ করা হয়। সরকারিভাবে এবং কয়েকটি এনজিও এলাকাবাসীর মধ্যে ট্যাঙ্ক বিতরণের নানা প্রকল্পে কাজ করছে। এসব এলাকায় রিজার্ভ পুকুর থাকলেও চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

উপকূলের জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন সংগঠন সংকল্প ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক মীর্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ বলেন, সচেতনতার অভাবে গ্রামের লোকজন ট্যাঙ্ক সুরক্ষা করেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর মুখ খোলা থাকে। এতে পানিতে মশা ডিম পাড়ার সুযোগ পায়। আবার বিনামূল্যে সরবরাহ করা এসব ট্যাঙ্কের মান কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো হয় না। এক বছর ব্যবহারের পরই অনেকটা অকেজো হয়ে পড়ে। 

খালেদ বলেন, বছরে তিন মাস বর্ষা থাকলে উপকূলবাসী সরাসরি বৃষ্টির পানি ব্যবহারের সুযোগ পায়। পরের ৩-৪ মাস ট্যাঙ্কে সংরক্ষিত পানি ব্যবহার করে। এর পরের মাসগুলোতে তারা দূরের কোনো নলকূপ কিংবা পুকুরে ফিল্টারে শোধিত পানির ওপর নির্ভরশীল।

তাঁর মতে, জেলার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সরকারি ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন সংগঠনের মাধ্যমে রিজার্ভ পুকুরে ফিল্টার স্থাপিত হলেও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ফলে শুষ্ক মৌসুমে ফিল্টারের পানি সংগ্রহে এক গ্রামের নারীদের আরেক গ্রামে যেতে হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফিল্টারের সামনে দীর্ঘ লাইন উপকূলের গ্রামে নিত্য দেখা যায়। 
পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের জেলেপল্লির চান মিয়া জানান, শুকনো মৌসুমে প্রতিদিন ১১ কিলোমিটার দূরে পৌরসভার রিজার্ভ পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করেন। সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া ট্যাঙ্কের পানিতে ডেঙ্গু মশা জন্ম নিচ্ছে বলে শুনেছেন।

সরকারি প্রকল্পেও অনিয়ম 
বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে ২০২২-২৩ ও ২৩-২৪ অর্থবছরে প্রকল্পের আওতায় বরগুনায় প্ল্যাটফর্মসহ ট্যাঙ্ক বিতরণ করা হয়। এটি ছিল ৩৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকার প্রকল্প। 
জানা গেছে, বরগুনার তৎকালীন দুই সংসদ সদস্য, উপজেলা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরা ৭ হাজার ৫৬০ জনের তালিকা করেন। তবে তালিকায় বেশির ভাগ নাম ওঠে সচ্ছল ব্যক্তির। এ নাম ওঠাতে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। টাকা দিতে না পারায় বঞ্চিত হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী।

(তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আমতলী প্রতিনিধি জাকির হোসেন, পাথরঘাটা প্রতিনিধি ইমাম হোসেন নাহিদ ও মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি মিজানুর রহমান মিজু)

আরও পড়ুন

×