ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

চট্টগ্রাম বন্দরের পরবর্তী অধ্যায়: বৈশ্বিক বাণিজ্য ও স্থানীয় সমৃদ্ধির সম্ভাবনা উন্মোচন

চট্টগ্রাম বন্দরের পরবর্তী অধ্যায়: বৈশ্বিক বাণিজ্য ও স্থানীয় সমৃদ্ধির সম্ভাবনা উন্মোচন

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫ | ২১:৫০ | আপডেট: ২৬ জুন ২০২৫ | ২১:৫৬

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি অপারেটর আনার প্রস্তাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিনা। তবে এই বিতর্কের মাঝে যে বিষয়টি আড়ালে পড়ে যাচ্ছে তা হলো, কীভাবে বন্দর পরিচালনায় কৌশলগত আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিল্পখাত এবং জনগণের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনতে পারে।

দেশের মোট সামুদ্রিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। যেমন– ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক স্থল পণ্য পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমনি গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনেও পরিবর্তন আসছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কের সঙ্গে আরও কার্যকর সংযুক্তি এবং বন্দরের আধুনিকায়ন এখন সময়োপযোগী। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, জুতা, চামড়াজাত পণ্যগুলো রপ্তানিনির্ভর খাতগুলোর প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখতে হলে কার্যকারিতা ও বৈশ্বিক সংযুক্তি আরও জোরদার করতে হবে।

বন্দর পরিচালনায় অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক অপারেটরদের যুক্ত করা মানে শুধু ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন নয়, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানিকে গ্লোবাল লজিস্টিকস নেটওয়ার্কের সঙ্গে কার্যকরভাবে যুক্ত করবে। ফলে দেশের রপ্তানিকারকরা এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান বন্দরগুলোর সঙ্গে কার্যকরভাবে সংযুক্ত হতে পারবেন। ডিপি ওয়ার্ল্ড, এ.পি. মল্লের-মেরস্ক, পিএসএ ইন্টারন্যাশনালের মতো কোম্পানিগুলো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু বন্দর পরিচালনা করে। আর এমন আন্তর্জাতিক বন্দর অপারেটর বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য দ্রুততর শিপমেন্ট, উন্নত কাস্টমস ও ট্রেড ফাইন্যান্স সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে। 

এই যোগাযোগের ফলে তৈরি পোশাক, জুতা, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দ্রুত ডেলিভারি, উচ্চ লাভ এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ পাবে। এ সুফল কেবল বন্দরে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং পুরো ভ্যালু চেইনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যার মাধ্যমে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নতুন গতি আসবে।

বাংলাদেশের পোশাক খাত ইতোমধ্যে এইচ অ্যান্ড এম, ইউনিক্লো, জারা ও লিভাইস-এর মতো শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলোর কাছে একটি নির্ভরযোগ্য সোর্সিং হাব হিসেবে পরিচিত। তবে এসব ব্র্যান্ড কেবল সস্তা পণ্য নয়, নির্ভরযোগ্য ও স্বচ্ছ সাপ্লাই চেইন চায়। শুল্ক বা পণ্য খালাসে জটিলতা, বিলম্ব কিংবা অস্থিরতা দেখা দিলে অর্ডার চলে যেতে পারে প্রতিযোগী অন্য কোনো দেশে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের লজিস্টিকস ব্যবস্থাকে বন্দর থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ সংযোগসহ সম্পূর্ণভাবে আধুনিক করতে হবে। একটি নিরাপদ, স্মার্ট ও আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত সাপ্লাই চেইন আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করে।

আন্তর্জাতিক বন্দর অপারেটিং প্রতিষ্ঠান দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এ বার্তা দেয় যে, বাংলাদেশ বৈশ্বিক মান বজায় রেখে স্থিতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

৪৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক শিল্প ছাড়াও চামড়া, ওষুধ এবং জুতা খাতের টেকসই প্রবৃদ্ধিও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। কাঁচামালের উচ্চমূল্য, বন্দরজট, জটিল কাস্টমস এবং অনিয়মিত সাপ্লাই চেইনের কারণে এই খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বন্দর পরিচালনায় অংশগ্রহণ করলে ডিজিটাল কাস্টমস প্ল্যাটফর্ম, আধুনিক ওয়্যারহাউজ সিস্টেম এবং তথ্যভিত্তিক স্মার্ট কার্গো ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কার্যকারিতা অনেক গুণ বাড়াতে পারে। এতে রপ্তানি প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে এবং অপ্রত্যাশিত বিলম্ব হ্রাস পাবে। কোভিড-পরবর্তী বাস্তবতায় দ্রুত লজিস্টিকস একটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা, সেখানে এসব উদ্যোগ আরও তাৎপর্যপূর্ণ। এর ফলে রপ্তানিকারকরা খরচের ধাক্কা কিছুটা সামলাতে পারবেন এবং দ্রুত পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন।

বেসরকারীকরণ মানেই চাকরি কমে যাবে এমন ধারণাও অনেকের রয়েছে। তবে বাস্তবতা বলছে, সক্ষমতা বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ে। শুধু বন্দরে নয়, পরিবহন, গুদামজাতকরণ ও সহায়ক খাতগুলোতেও নতুন নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হয়। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক অপারেটর স্থানীয় কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করে, যা কর্মীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে মূল্য যোগ করে।
আরেকটি উদ্বেগ হলো, বিদেশি অপারেটররা মুনাফা বিদেশে নিয়ে যাবে। তবে সঠিক পিপিপি মডেলের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট কাঠামোতে বিনিয়োগ, রাজস্ব বণ্টন ও করনীতি নিশ্চিত থাকলে জাতীয় রাজস্ব রক্ষা করা সম্ভব। উপরন্তু, অর্থনীতির সম্প্রসারণে সরকারের মোট রাজস্বও বাড়ে।

আরেকটি সাধারণ উদ্বেগ হলো, বিদেশি অপারেটররা তাদের লভ্যাংশ বিদেশে পাঠাবে, যার ফলে দেশের রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে সঠিকভাবে প্রণয়ন করা চুক্তির মাধ্যমে রাজস্ব ভাগাভাগি, বাধ্যতামূলক পুনঃবিনিয়োগ এবং ন্যায্য কর ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেওয়া যায়। তদুপরি, উন্নত বাণিজ্য অবকাঠামোর ফলে যে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ঘটে, তা সাধারণত সরকারের মোট রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বেসরকারীকরণ মানে জাতীয় সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া নয়। অবকাঠামোর মালিকানা রাষ্ট্রের কাছেই থাকবে, নীতিনির্ধারণ থাকবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হাতে। সঠিক নজরদারি ও চুক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ তার স্বার্থ রক্ষা করেই বৈশ্বিক দক্ষতার সুফল নিতে পারবে। 

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের লজিস্টিকস অবকাঠামো বর্তমানে চাপের মুখে। চট্টগ্রাম বন্দরে এরই মধ্যে সীমাবদ্ধতা ও জট সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এখন কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে মূল্যবান বাণিজ্যিক সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে, পণ্য পরিবহন অন্য দেশে চলে যেতে পারে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাও কমে যেতে পারে। 

এই প্রেক্ষাপটে কৌশলগত আধুনিকায়ন ও বেসরকারীকরণ হতে পারে বাংলাদেশের বাণিজ্য সক্ষমতা বাড়ানোর একটি কার্যকর পথ। আন্তর্জাতিক বন্দর অপারেটররা পুঁজি, আধুনিক প্রযুক্তি এবং সমন্বিত লজিস্টিকস সেবা নিয়ে এসে চট্টগ্রামকে একটি প্রতিযোগিতামূলক আঞ্চলিক হাব-এ রূপান্তর করতে ভূমিকা রাখতে পারে।

এটি নিয়ন্ত্রণ হারানোর নয়, বরং একটি লাভজনক অংশীদারিত্ব। সুচিন্তিত পরিকল্পনা, স্বচ্ছ শর্ত এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে বেসরকারীকরণ এমন একটি গতি সঞ্চার করতে পারে, যা সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রেখেই প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।

বাংলাদেশ রপ্তানি বাড়াতে এবং বিশ্ববাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে কাজ করছে। তাই বন্দর আধুনিক করা এখন খুবই জরুরি। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন হওয়া উচিত সঠিক পরিকল্পনা আর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে। (স্পন্সরড কনটেন্ট )

আরও পড়ুন

×