সুনামগঞ্জে শতকোটির বালুমহাল নিয়ে বিএনপির দু’পক্ষে দ্বন্দ্ব

ইজারাসীমা অতিক্রম করে পরিবেশ বিধ্বংসী বোমা বা সেইভ মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে ক্ষতবিক্ষত সুনামগঞ্জের জাদুকাটা নদী। প্রভাবশালী একটি চক্র প্রকাশ্যে দিনের পর দিন বালু উত্তোলন করলেও নজর নেই প্রশাসনের- সমকাল
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫ | ২৩:৪৯
সুনামগঞ্জের শতকোটি টাকার যাদুকাটা বালুমহাল ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে বিএনপির দু’পক্ষ। এই দ্বন্দ্বে গোয়েন্দা পুলিশকেও (ডিবি) জড়ানো হয়েছে। ডিবির সদস্যরা ঢাকায় ইজারাদারকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে পৌনে ৬ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এই বালুমহাল বিগত সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা ভোগ করতেন। সরকার পতনের পর মহালের দখলে নেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এই ধারাবাহিকতায় চলতি বাংলা বছরেও যৌথভাবে ইজারা পান বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ীরা। ইজারা কার্যক্রম নিয়ে এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান ও দলীয় সমর্থক ব্যবসায়ী নাছির মিয়া দ্বন্দ্বে জড়ান। এই দ্বন্দ্বে বিএনপি নেতা তাহিরপুরের সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুলের নামও উঠে এসেছে।
শনিবার বিকেলে শহরের একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলন করে চাপ দিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগের কথা জানান যাদুকাটা বালুমহালের ইজারাদার ও ভুক্তভোগী নাছির মিয়া। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, যাদুকাটা বালুমহাল বৈধভাবে ইজারা পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ইজারাদার রতন মিয়ার ঘনিষ্ঠ খোরশেদ মিয়া ৫ মার্চ হাইকোর্টে মামলা করেন। পরে ইজারা কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেন আদালত। মাহবুবুর রহমান যাদুকাটায় এর আগে অংশ দেওয়ার দাবি করলে অন্য পক্ষের মধ্যস্থতায় ৩০ শতাংশ শেয়ার দিতে রাজি হই। তবুও কেন্দ্রীয় যুবদল নেতা তাদের দিয়ে মামলা করিয়েছেন।
নাছির মিয়া জানান, গত ২৫ জুন এ বিষয়ে হাইকোর্টে আইনি লড়াইয়ের জন্য যান তারা। সেখানে রতন মিয়া ও মাহবুবুর রহমানের নির্দেশে সেগুনবাগিচার দুদক কার্যালয়ের সামনে থেকে কয়েকজন ডিবি সদস্য তাঁকে মিন্টো রোডের কার্যালয়ে তুলে নিয়ে যান। সেখানে মানসিকভাবে নির্যাতন এবং মামলা না চালানোর জন্য চাপ দেওয়া হয় তাঁকে। পরে অভিযুক্ত মাহবুবুর রহমান ডিবি অফিসে গিয়ে তাঁর কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। এক পর্যায়ে ডিবির সদস্যরা তাঁর কাছে থাকা ৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা আদায় করেন। পরে সাজানো মুচলেকায় জোরপূর্বক স্বাক্ষর রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন তিনি।
এই বিষয়ে ডিবি বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কাউকে জানিয়েছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে এই ভুক্তভোগী ইজারাদার বলেন, রোববার ঢাকায় গিয়ে পুলিশ প্রধানকে জানাব এবং একই সঙ্গে উচ্চ আদালতে মামলাও করব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ-১ (ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর ও মধ্যনগর) আসনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়নপ্রত্যাশী মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, যাদুকাটা ইজারা নেওয়ার জন্য আমি শিডিউল কিনিনি। আমার সঙ্গে এই বিষয়ে কারও কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তারা স্থগিতাদেশ থাকা অবস্থায় মহাল ইজারা নিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করতে চায়।
ডিবি কার্যালয়ে নির্যাতনের অভিযোগসহ সংবাদ সম্মেলনে বলা সবকিছুই সাজানো দাবি করে যুবদল নেতা বলেন, তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল এই নাটক সাজিয়েছেন। তিনি এই আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী, আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এসব কাজ করাচ্ছেন।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, সুনামগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, সহজ-সরল ব্যবসায়ীকে ডিবি অফিসে অমানুষিক নির্যাতন করিয়েছে– ব্যবসায়ী নিজেই সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন। যাদুকাটা ইজারাবিহীন থাকায় হাজারো শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসাইন জানান, কোন ব্যবসায়ীকে ডিবি পুলিশ কোথাও নিয়ে নির্যাতন করেছে, এ ধরনের কোনো অভিযোগ তারা পাননি।
জেলার তাহিরপুর উপজেলার আলোচিত বালুমহাল যাদুকাটা-১ ও যাদুকাটা-২ চলতি সালে ১০৭ কোটি টাকায় ইজারা হয়। যাদুকাটা-১-এর ইজারা নাছির মিয়া এবং যাদুকাটা-২-এর ইজারা পান শাহ্ রুবেল আহমেদ নামের এক ব্যবসায়ী। তাদের সঙ্গে বিএনপির স্থানীয় ও জেলা নেতাদের অনেকে শরিক রয়েছেন বলে স্থানীয়ভাবে আলোচনা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনের পর যাদুকাটা-২-এর ইজারাদার শাহ রুবেল জানান, সরকারকে বৈধভাবে রাজস্ব দিয়ে ইজারা পাওয়ার পরও তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তিনি আশঙ্কা করছেন, যে কোনো সময় তাঁর ওপর হামলা হতে পারে।
- বিষয় :
- বালু উত্তোলন